নদীর উচ্চপ্রবাহে ক্ষয়কার্যের ফলে যে ভূমিরূপ গড়ে ওঠে, তার বর্ণনা দাও। অথবা, একটি আদর্শ নদীর বিভিন্ন ক্ষয়কাজের ফলে গঠিত তিনটি ভূমিরূপের চিত্রসহ সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও। অথবা, নদীপ্রবাহের যে-কোনও একটি অংশে নদীর কার্যের বিবরণ দাও। উচ্চপ্রবাহ বা পার্বত্য প্রবাহে নদীর প্রধান কাজ হল ক্ষয় করা। এর সঙ্গে বহন ও অতি সামান্য পরিমান সঞ্চয়কার্য ও করে থাকে। পার্বত্য অঞ্চলে ভূমির ঢাল বেশি থাকে বলে এই অংশে নদীপথের ঢাল খুব বেশি হয়, ফলে নদীর স্রোতও খুব বেশি হয়। স্বভাবতই পার্বত্য অঞ্চলে নদী তার প্রবল জলস্রোতের সাহায্যে কঠিন পাথর বা শিলাখণ্ডকে ক্ষয় করে এবং ক্ষয়জাত পদার্থ ও প্রস্তরখণ্ডকে সবেগে বহনও করে। উচ্চ প্রবাহে নদীর এই ক্ষয়কার্য প্রধানত চারটি প্রক্রিয়ার দ্বারা সম্পন্ন হয়। এই প্রক্রিয়া গুলি হলো - অবঘর্ষ ক্ষয়, ঘর্ষণ ক্ষয়, জলপ্রবাহ ক্ষয় ও দ্রবণ ক্ষয়। নদীর ক্ষয়কাজের ফলে বিভিন্ন ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়, যেমন: (১) ইংরেজি "।" এবং "V" অক্ষরের মতো নদী উপত্যকা: পার্বত্য গতিপথের প্রথম অবস্থায় প্রবল বেগে নদী তার গতিপথের নীচের দিকে ক্ষয়কাজ বেশি করে বলে নদী-খাত প্রথমে '।'
সাঁওতাল বিদ্রোহ
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের পূর্বে সংগঠিত প্রতিবাদী আন্দোলনগুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সাঁওতাল উপজাতির অভ্যুত্থান (১৮৫৫ খ্রি.)। ড. কালিকিংকর দত্ত তাঁর “দি সাঁওতাল ইনসারেক্সন অব ১৮৫৫-৫৭' গ্রন্থে লেখেন—“বাংলা ও বিহারের ইতিহাসে এই পর্ব (সাঁওতাল বিদ্রোহ) নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটায়।”
সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ—
(১) রাজস্বের বোঝা—
কর্নওয়ালিশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করলে সাঁওতালদের বাসভূমি বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, বীরভূম, ছোটোনাগপুর প্রভৃতি অঞ্চল কোম্পানির রাজস্বের অধীনে আসে। ফলে এসব অঞ্চলে বসবাসকারী সাঁওতালরা রাজমহলের পার্বত্য অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করে এবং রুক্ষ মাটিকে কৃষিকাজের উপযুক্ত করে জীবনধারণ করতে থাকে। এই অঞ্চল ‘দামিন-ই-কোহ’ (পাহাড়ের প্রান্তদেশ) নামে পরিচিত হয়। কিন্তু কিছুদিন পরে সরকার এই অঞ্চলকেও জমিদারি বন্দোবস্ত ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করে। ফলে সাঁওতালদের ওপর রাজস্বের বোঝা চাপে। এতে সাঁওতালরা ক্ষুব্ধ ও বিদ্ৰোহমুখী হয়৷
(২) মহাজনি শোষণ—
কালক্রমে দামিন-ই-কোহ-তে মহাজনদের আবির্ভাব ঘটে। ধূর্ত ও অর্থলোভী মহাজনরা সহজসরল সাঁওতালদের শোষণ করতে শুরু করে। ঋণের জালে সাঁওতালদের জড়িয়ে তারা মুনাফা লুটতে থাকে। রাজস্ব প্রদান এবং খাদ্যাভাব মেটাতে বহু সাঁওতাল পরিবার চড়া সুদের বিনিময়ে ঋণ নিতে বাধ্য হয়। একবার ঋণ নিলে সেই ঋণ শোধ করতে হত বংশপরম্পরায়। এই জাল থেকে মুক্তির আশায় সাঁওতালরা বিদ্রোহী হয়।
(৩) সাঁওতাল আইন বাতিল—
সরকার সাঁওতালদের নিজস্ব আইন ও বিচারপদ্ধতি বাতিল করে সাঁওতাল এলাকায় ইংরেজদের জটিল আইন ও বিচারব্যবস্থা চালু করে।
(৪) ব্যবসায়ীদের প্রতারণা—
বাইরে থেকে সাঁওতাল পরগনাতে এসে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সাঁওতালদের সরলতা ও অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে তাদের ঠকাত। 'কেনারাম' নামক বাটখারার দ্বারা সঠিক ওজনের থেকে বেশি দ্রব্য ক্রয় ও ‘বেচারাম' নামক বাটখারার দ্বারা সঠিক ওজন অপেক্ষা কম দ্রব্য দিয়ে সাঁওতালদের ঠকানো হত। অসাধু ব্যবসায়ীদের এই প্রতারণা সাঁওতালদের উত্তেজিত করে।
(৫) নীলকরদের শোষণ—
সাঁওতালদের ক্ষোভের আরও একটি কারণ ছিল নীলকর সাহেবদের শোষণ ও অত্যাচার। নীলচাষ করতে অস্বীকার করলে নীলকর সাহেবরা নিরীহ সাঁওতালদের ওপর অকথ্য অত্যাচার করত। এই অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সাঁওতালরা বিদ্রোহের পথ বেছে নেয়।
(৬) খ্রিস্টধর্ম প্রচার—
খ্রিস্টান মিশনারিরা সাঁওতালদের ধর্মকে অবজ্ঞা করত এবং সুকৌশলে সাঁওতালদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করত।
(৭) অন্যান্য কর—
ভূমিরাজস্ব ছাড়াও সরকার, জমিদার প্রমুখ সাঁওতালদের ওপর বিভিন্ন ধরনের করের বোঝা চাপিয়ে দেয়। ফলে দরিদ্র সাঁওতালদের দুর্দশা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়৷
(৮) সরকারি কর্মচারীদের অত্যাচার—
সরকারি প্রশাসন ও বিচারবিভাগ অন্যায়ভাবে জমিদার, মহাজন ও ব্যবসায়ীদের সমর্থন করে। উপজাতিভুক্ত সাঁওতালদের ‘সভ্যতার লজ্জা’ মনে করে উদ্ধত ইংরেজ কর্মচারীরাও সাঁওতালদের ওপর অত্যাচার ও শোষণ চালাতে থাকে। এই সার্বিক শোষণ ও অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তারা শেষপর্যন্ত বিদ্রোহের পথই বেছে নেয়।
(৯) রেল-কর্মচারী ও ঠিকাদারদের নির্যাতন—
উনিশ শতকে তিলা পাহাড়, ভাগলপুর অঞ্চলে রেললাইন পাতার কাজ শুরু হয়। এই কারণে বহু রেল-কর্মচারী ও ঠিকাদার ‘দামিন-ই-কোহ’-তে আসে। তারা সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে দরিদ্র সাঁওতালদের কাছ থেকে অল্পমূল্যে বা বিনামূল্যে হাঁস, মুরগি, ছাগল, ফলমূল নিতে শুরু করে, এমনকি সাঁওতাল রমণীদের প্রতিও তারা অশালীন আচরণ করে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সাঁওতাল সমাজ ভদ্রলোক-বিরোধী বা দিকু-বিরোধী আন্দোলন শুরু করে।
সাঁওতাল বিদ্রোহের বিবরণ—
ভারতের প্রাচীন বাসিন্দা আদিবাসী সাঁওতালরা বর্তমান বিহারের ছোটোনাগপুর, পালামৌ, মানভূম এবং বাংলার বীরভূম, বাঁকুড়া ও মেদিনীপুর জেলার বিস্তীর্ণ বনভূমি অঞ্চলে বসবাস করত। তারা ১৮৫৫-৫৬ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ইংরেজ সরকার, জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে যা 'হুল বিদ্রোহ' বা ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ' নামে পরিচিত।
সিধু ও কানহুর নেতৃত্ব—
জমিদার, মহাজন ও ইংরেজের অত্যাচারের প্রতিবাদে সিধু ও কানহু নামে দুই ভাইয়ের নেতৃত্বে সাঁওতালরা সংঘবদ্ধ হয়। সাঁওতাল ও অন্যান্য উপজাতির মানুষকে সংগঠিত করার জন্য সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে ‘শালগাছের ডাল’ পাঠানো হয়। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুন প্রায় দশ হাজার সাঁওতাল ভাগনাডিহি-র মাঠে মিলিত হয়। সিধু-কানহুর নেতৃত্বে ক্ষিপ্ত সাঁওতালরা পাঁচকাঠিয়া বাজারে উপস্থিত হয়। পাঁচজন স্থানীয় মহাজন ও দিঘি থানার অত্যাচারী দারোগাকে হত্যা করে সাঁওতাল বিদ্রোহের সূচনা হয়।
বিদ্রোহের প্রসার—
শত শত সাঁওতাল যুবক তিরধনুক নিয়ে বিদ্রোহে সামিল হয়। রাজমহল থেকে মুরশিদাবাদ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দ্রুত বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। সাঁওতালরা একে একে মহেশপুর ও পাকুড়ের রাজবাড়ি দখল করে। প্রচুর নীলকুঠি ধ্বংস করে এবং রেল-সাহেবদের বাংলোয় আক্রমণ চালায়।
বিদ্রোহের অবসান—
সরকার বিদ্রোহী সাঁওতালদের দমন করতে সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেয়। ইংরেজ-বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারায় হাজার হাজার সাঁওতাল। সিধু-কানহুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বহু বন্দি সাঁওতালকে ফাঁসি দেওয়া হয়। শেষপর্যন্ত ব্রিটিশের দমননীতির কাছে স্তিমিত হয়ে পড়ে সাঁওতাল বিদ্রোহ।
ব্রিটিশ শাসনকালের প্রথম পর্বে আদিবাসী কৃষক আন্দোলনগুলির মধ্যে সাঁওতাল বিদ্রোহই সর্বপ্রথম ব্যাপক আকার ধারণ করে। পি. সি. যোশী বলেছেন যে, সাঁওতাল বিদ্রোহের একটি বিশেষ দিক ছিল স্বাধীনতার কামনা, সাঁওতাল অঞ্চল ও সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠার চিন্তা।
সাঁওতাল বিদ্রোহের গুরুত্ব—
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের পূর্ববর্তীকালে ভারতে সংঘটিত ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনগুলির মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের বিদ্রোহ (১৮৫৫ খ্রি.)। আপাতব্যর্থ এই বিদ্রোহের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিশ্লেষণে দেখা যায়—
(১) পৃথক সাঁওতাল পরগনা গঠন—
সাঁওতাল বিদ্রোহের তীব্রতায় ব্রিটিশ কোম্পানি বাধ্য হয় সাঁওতালদের জন্য আলাদা পরগনা গঠন করতে। উত্তরে গঙ্গার নিকটবর্তী তেলিয়াগড়াই পরগনার সঙ্গে বীরভূম ও ভাগলপুরের নয় হাজার বর্গকিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে তৈরি করা হয় সাঁওতাল পরগনা। তিন বছরের জন্য এই পরগনায় মহাজনদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
(২) সোচ্চার প্রতিবাদ—
এই বিদ্রোহের মাধ্যমে সাঁওতালরা ইংরেজ আশ্রয়পুষ্ট জমিদার ও মহাজনশ্রেণির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুর করে। তাদের সোচ্চার প্রতিবাদ ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনকে প্রেরণা দিয়েছিল।
(৩) অন্য বর্ণের মানুষের যোগদান—
সাঁওতাল বিদ্রোহ কেবল সাঁওতালদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সাঁওতাল বিদ্রোহে বিভিন্ন নিম্নবর্ণের মানুষ অংশগ্রহণ করে এবং তাদের মধ্যে ঐক্য গড়ে ওঠে।
(৪) বিশেষ অধিকারের স্বীকৃতি—
সাঁওতাল পরগনার শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয় পুলিশের পরিবর্তে সাঁওতাল গোষ্ঠীপতিদের ওপর। শান্তিরক্ষার জন্য এদের বিশেষ কিছু অধিকার দান করা হয়।
(৫) মহাবিদ্রোহের পথনির্দেশ—
এই বিদ্রোহ কৃষক তথা সাধারণ মানুষকে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রেরণা জোগায়, যা পরবর্তীকালে মহাবিদ্রোহের পথ প্রশস্ত করে। এই বিদ্রোহে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে। পরবর্তীকালে সংঘটিত সিপাহি বা মহাবিদ্রোহে তা সম্পূর্ণ প্রকাশিত হয়।
(৬) সরকারি নমনীয়তা—
বিদ্রোহের পর সরকার সাঁওতালদের প্রতি কিছুটা নমনীয় মনোভাব গ্রহণ করে। [i] সাঁওতালদের পৃথক ‘উপজাতি’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং সাঁওতাল-অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে সাঁওতাল পরগনা নামে জেলা গঠন করা হয়। [ii] ঘোষণা করা হয় যে, সাঁওতাল পরগনায় ব্রিটিশ আইন কার্যকর হবে না। [iii] সাঁওতালদের ওপর ঋণের সুদের হার বেঁধে দেওয়া হয়। [iv] সাঁওতাল পরগনায় ইউরোপীয় মিশনারি ছাড়া অন্যদের প্রবেশ এবং বাঙালি মহাজনদের বসবাস নিষিদ্ধ হয়। এভাবে ভারতীয় জনজীবন থেকে সাঁওতালরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
(৭) প্রেরণা—
সাঁওতাল বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে চাষিদের বিদ্রোহের আগুন থেমে যায়নি। পরবর্তীকালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে গরিব ও নিম্নবর্ণের সাঁওতালদের এই বিদ্রোহ প্রেরণা জুগিয়েছিল।
(৮) বীরত্ব—
সাঁওতাল বিদ্রোহে দরিদ্র কৃষকদের স্বাধীনতা লাভ ও শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা লক্ষ করা যায়। সাঁওতালরা সশস্ত্র ইংরেজ বাহিনীর সামনে তিরধনুক, বর্শা, কুড়ুল প্রভৃতি নিয়ে যে বীরত্ব দেখিয়েছিল তা পরবর্তীকালে আন্দোলনকে উৎসাহিত করে।
উপজাতি-অধ্যুষিত আদিবাসী বিদ্রোহগুলির মধ্যে সাঁওতাল বিদ্রোহই প্রথম ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তিমূল কাঁপিয়ে দিতে পেরেছিল। সাঁওতাল বিদ্রোহে ইংরেজরা খুবই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে সাঁওতালরা যাতে আর বিদ্রোহ করতে না পারে, সেজন্য তাদের দুর্বল করে রাখার চেষ্টা করা হয়। উপযুক্ত শিক্ষা, শিল্প ও বাণিজ্যের সুযোগ না দিয়ে সরকার তাদের অনুন্নত করে রাখার ব্যবস্থা করেন। ফলে বিদ্রোহের পরও সাঁওতালদের অসন্তুষ্টি থেকেই যায়। সাঁওতাল বিদ্রোহ সমাজের সকল সম্প্রদায়ের দরিদ্র জনগণের মুক্তিযুদ্ধ হয়ে উঠেছিল। অধ্যাপক নরহরি কবিরাজের মতে—“সাঁওতাল বিদ্রোহ আপসহীন গণসংগ্রামের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।”
Comments
Post a Comment