Skip to main content

সাম্প্রতিক পোস্ট

প্রাচীন ভারত ও ভৌগোলিক প্রেক্ষাপট (Ancient India and Geographical Context)

প্রাচীন ভারত ও ভৌগোলিক প্রেক্ষাপট (Ancient India and Geographical Context) ভারতবর্ষ' নামকরণ:          আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি 'ভারতবর্ষ'-বিশ্বের অন্যতম প্রাচীনতম দেশ। ডঃ রামশরণ শর্মা-র মতে, 'ভারত'-নামক এক প্রাচীন উপজাতির নামানুসারে আমাদের দেশের নাম হয় 'ভারতবর্ষ'। ভারবর্ষকে 'ইন্ডিয়া'ও বলা হয়ে থাকে। সম্ভবত 'সিন্ধু' শব্দ থেকে 'হিন্দু'র শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে; আর গ্রিক ও রোমানদের 'হিন্দু' উচ্চারণ হত 'ইন্ডুস্' বা Indus থেকে। এই প্রাচীন Indus থেকেই বর্তমান India শব্দটির উৎপত্তি। আর, এ-থেকেই গ্রিস লেখক মেগাস্থিনিস-এর বিখ্যাত গ্রন্থটির নাম হয়েছে 'ইন্ডিকা'। ভারতবর্ষের মোট আয়তন ৩২,৮০,৪৮৩ বর্গকিলোমিটার। উত্তর-দক্ষিণে ৩,২০০ কিলোমিটার লম্বা এবং পূর্ব-পশ্চিমে ৩,০০০ কিলোমিটার চওড়া। ভারতবর্ষের উত্তরদিকে চিন, নেপাল ও ভুটান; উত্তর-পশ্চিম দিকে পাকিস্তান; পশ্চিমদিকে আরব সাগর; দক্ষিণদিকে ভারত মহাসাগর এবং পূর্ব দিকে ব্রহ্মদেশ, বাংলাদেশ ও বঙ্গোপসাগর অবস্থিত। এ ছাড়া আরবসাগরে অবস্থিত লাক্ষা, মিনিকয়; বঙ্গোপসাগরের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ...

প্রাচীন ভারত ও ভৌগোলিক প্রেক্ষাপট (Ancient India and Geographical Context)

প্রাচীন ভারত ও ভৌগোলিক প্রেক্ষাপট (Ancient India and Geographical Context)


ভারতবর্ষ' নামকরণ: 

        আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি 'ভারতবর্ষ'-বিশ্বের অন্যতম প্রাচীনতম দেশ।
ডঃ রামশরণ শর্মা-র মতে, 'ভারত'-নামক এক প্রাচীন উপজাতির নামানুসারে আমাদের দেশের নাম হয় 'ভারতবর্ষ'। ভারবর্ষকে 'ইন্ডিয়া'ও বলা হয়ে থাকে। সম্ভবত 'সিন্ধু' শব্দ থেকে 'হিন্দু'র শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে; আর গ্রিক ও রোমানদের 'হিন্দু' উচ্চারণ হত 'ইন্ডুস্' বা Indus থেকে।

এই প্রাচীন Indus থেকেই বর্তমান India শব্দটির উৎপত্তি। আর, এ-থেকেই গ্রিস লেখক মেগাস্থিনিস-এর বিখ্যাত গ্রন্থটির নাম হয়েছে 'ইন্ডিকা'। ভারতবর্ষের মোট আয়তন ৩২,৮০,৪৮৩ বর্গকিলোমিটার। উত্তর-দক্ষিণে ৩,২০০ কিলোমিটার লম্বা এবং পূর্ব-পশ্চিমে ৩,০০০ কিলোমিটার চওড়া। ভারতবর্ষের উত্তরদিকে চিন, নেপাল ও ভুটান; উত্তর-পশ্চিম দিকে পাকিস্তান; পশ্চিমদিকে আরব সাগর; দক্ষিণদিকে ভারত মহাসাগর এবং পূর্ব দিকে ব্রহ্মদেশ, বাংলাদেশ ও বঙ্গোপসাগর অবস্থিত। এ ছাড়া আরবসাগরে অবস্থিত লাক্ষা, মিনিকয়; বঙ্গোপসাগরের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ভারতবর্ষের অন্তর্গত। বলাবাহুল্য, ভারতবর্ষের উত্তর দিক জুড়ে সর্বদা অতন্ত্র প্রহরীর কাজ করে চলেছে হিমালয় পর্ব তমালা।

ভৌগোলিক উপাদান: 

        ভারতবর্ষকে 'উপমহাদেশ' বলা হয়। কেন-না ভারতের ভূপ্রকৃতিতে মহাদেশের বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। এখানে আছে মাউন্ট এভারেস্টের মতো গিরিশৃঙ্গ, আবার সিন্ধু-গঙ্গা-বিধৌত সমভূমি; আছে মৌসিনরামের মতো বৃষ্টিপাতযুক্ত অঞ্চল, আবার রাজস্থানের দিগন্তবিস্তৃত মরুভূমি। ভারতবর্ষের তিন দিক মহাসাগর দ্বারা বেষ্টিত। তেমনি অসংখ্য নদনদী ভারতবর্ষকে শস্য-শ্যামলা করেছে, সেই সাথে দণ্ডকারণ্যের মতো গহন অরণ্য মিলেমিশে ভারতবর্ষকে মহাদেশের পর্যায়ে উন্নীত করেছে। এই প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের সাথে সাথে পৃথিবীর বহু জনগোষ্ঠী ও বহু জাতির মিশ্রণ লক্ষ করা যায় ভারতবর্ষে। তাই, ভারতবর্ষকে ক্ষুদ্রাকৃতি মহাদেশ বললে অত্যুক্তি হয় না।

প্রাকৃতিক বিভাগ: 

        প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে ভারতবর্ষকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলি হল-
(১) উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল, 
(২) সিন্ধু-ব্রহ্মপুত্র-গঙ্গা-বিধৌত উর্বর সমতলভূমি, 
(৩) মধ্য ভারতের মালভূমি অঞ্চল, 
(৪) দক্ষিণ ভারতের মালভূমি অঞ্চল, 
(৫) সুদূর দাক্ষিণাত্য। ভারতীয় ইতিহাসের ওপর ভারতের এই ভৌগোলিক পরিবেশের প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।


হিমালয়ের প্রভাব: 

        হিমালয় ভারতবর্ষকে বিভিন্নভাবে সমৃদ্ধ করেছে। A Survey of Indian History গ্রন্থে ঐতিহাসিক কে. এম. পানিরূর ভারতবর্ষকে হিমালয়ের দান বলে উল্লেখ করেছেন। ভারত ইতিহাসের গতিধারায় হিমালয়ের প্রভাব অপরিসীম। যেমন-

(১) জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ: 

        দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুকে বাধাদান করে বৃষ্টিপাত ঘটাতে সাহায্য করেছে হিমালয় পর্বতমালা। এই বৃষ্টিপাত ভারতবর্ষকে শস্য-শ্যামলা করে তুলেছে। নদীগুলিকে সারাবছর নাব্যতা দিয়েছে হিমালয়ের বরফগলা জল। মধ্য এশিয়ার প্রচণ্ড শীতল বায়ুপ্রবাহকে বাধা দিয়ে ভারতের জলবায়ুকে নাতিশীতোষা রেখেছে।

(২) প্রাকৃতিক সুরক্ষা: 
        ভারতের উত্তর সীমান্তে প্রায় ২৫০০ কিলোমিটার এলাকায় সজাগ প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে হিমালয় পর্বতমালা। প্রকৃতির দেওয়া এই প্রাচীর বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে ভারতবর্ষকে রক্ষা করে চলেছে।

(৩) গিরিপথের ভূমিকা: 
        হিমালয়ের খাইবার, বোলান, নাথুলা, গোমাল প্রভৃতি গিরিপথগুলি দিয়ে যুগ যুগ ধরে এদেশে এসেছে আর্য, গ্রিক, পারসিক, শক, হুণ, পহ্লব, তুর্কি, মোগল প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠী। তেমনি ভারতীয়গণও এই পথ ধরে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে গড়ে তুলেছে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক সম্পর্ক। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর আগমনে ভারতীয় শিল্প-সংস্কৃতি যেমন সমৃদ্ধ হয়েছে, তেমনি আগত জাতিগোষ্ঠীগুলিও ভারতীয় সংস্পর্শে এসে নিজেরা সমৃদ্ধ হয়েছে। এই পথে যেমন আক্রমণকারীর প্রবেশ ঘটেছে, আবার ধর্মপ্রচারক ও তীর্থযাত্রীর দলও এই পথেই ভারতে প্রবেশ করেছে। ফলে, বহির্বিশ্বের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ নিবিড় হয়েছে।

(৪) সভ্যতার বিকাশঃ 

        হিমালয়ের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ধর্মীয় স্থান এবং শৈলশহর। হিমালয়ের বরফগলা জলে পুষ্ট হয়ে গঙ্গা, যমুনা, বিপাশা, শতদ্রু, ঝিলাম প্রভৃতি নদী-তীরবর্তী অঞ্চলে যুগ যুগ ধরে গড়ে উঠেছে বহু শহর-নগর-বাণিজ্যকেন্দ্র। এভাবে হিমালয় একটা সভ্যতার বিকাশে সাহায্য করে চলেছে।

(৫) অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি: 

        হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চল থেকে আহরিত কাঠ ও খনিজ পদার্থ ভারতীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এ ছাড়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য হিমালয়ের বিভিন্ন স্থানে বহু পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। এইসব পর্যটন কেন্দ্রের ওপর নির্ভর করে বহু মানুষ তাদের জীবিকানির্বাহ করে।

বিন্ধ্যপর্বতের প্রভাব: 

        ভারতবর্ষের মধ্যভাগে দাঁড়িয়ে থেকে বিন্ধ্যপর্বত ভারতবর্ষকে দু-ভাগে ভাগ করেছে। দক্ষিণ ভারতকে বৈদেশিক শত্রুর হাত থেকে অনেকাংশে রক্ষা করেছে। ভারতের ইতিহাসে বিন্ধ্যপর্বতের কতকগুলি প্রভাব হল-

(১) দক্ষিণ ভারতের সুরক্ষা প্রাচীর:

        বিন্ধ্যপর্বতের জন্য দক্ষিণ ভারতকে বারবার উত্তর ভারতের মতো বৈদেশিক আক্রমণের সম্মুখীন হতে হয়নি। ফলে, দক্ষিণ ভারতের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বহুদিন পর্যন্ত বজায় ছিল।

(২) স্বতন্ত্র সংস্কৃতি: 

        বিন্ধ্যপর্বতের জন্য দাক্ষিণাত্যে রাজনৈতিক স্থিরতা লক্ষ করা যায়। আর এজন্য দাক্ষিণাত্যে নিজস্ব আঙ্গিকে দ্রাবিড়ীয় সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে উন্নত ও মৌলিক শিল্প-সংস্কৃতি ও স্থাপত্য রীতি।

(৩) অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি: 

        বিন্ধ্যপর্বতের খনিজ ও বনজ সম্পদ দাক্ষিণাত্যের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে।

(৪) জাতিগত বিশুদ্ধতা রক্ষাঃ 

        উত্তর ভারত বিভিন্ন বিদেশি আক্রমণের কবলে পড়েছে, কিন্তু বিন্ধ্যপর্বত দক্ষিণ ভারতকে রক্ষা করেছে। আর্যাবর্তে বা উত্তর ভারতে বিদেশি জাতিগোষ্ঠী এসে এক মিশ্র সংস্কৃতির সৃষ্টি ।।- বিন্ধ্যপর্বতের জন্য দাক্ষিণাত্যের প্রাচীনত্ব ও বিশুদ্ধতা অনেকাংশে রক্ষিত হয়।

মূল্যায়ন: 

        পরবর্তীকালে সমুদ্রগুপ্ত, আলাউদ্দিন খলজি, আকবর প্রমুখ পরাক্রমশালী নৃপতিবর্গ আর্যাবর্ত ও দাক্ষিণাত্যের অধীশ্বর হলে দুই প্রান্তের রাজনৈতিক মিলন সম্ভব হয়। জন্ম নেয়-মিশ্র সংস্কৃতির ভারতবর্ষ।

নদনদীর প্রভাব :

        ভারত-একটি নদীমাতৃক দেশ। ভারতীয় সভ্যতার সূচনা ঘটে নদী-অববাহিকা অম্বল থেকে। ভারতীয় ইতিহাসের ওপরও সিন্ধু, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, গোদাবরী, যমুনা প্রভৃতি নদনদীর যথেষ্ট প্রভাব বর্তমান। নদ-নদীগুলি ভারতের উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলিকে সিক্ত করেছে, পলি মৃত্তিকায় উর্বর করেছে, আর শস্য-শ্যামলা করে ভারতীয় কৃষি-অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে। অন্য দিকে নদী-উপকূলবর্তী অঞ্চলেই গড়ে উঠেছে জনপদ, নগর, বাণিজ্যকেন্দ্র বা তীর্থস্থান।

(১) সভ্যতার বিকাশ: 

        সিন্ধুনদের অববাহিকাতেই জন্ম নেয় পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন সভ্যতা। পঞ্চনদীর তীরে বিকাশ ঘটে বৈদিক সভ্যতার। পরবর্তীকালে গঙ্গা-অববাহিকা ধরে বৈদিক সভ্যতার বিকাশ ঘটে।

(২) নগরায়ণঃ 

        ভারতীয় নদনদীগুলির তীরেই গড়ে উঠেছে দিল্লি, আগ্রা, এলাহাবাদ, পাটলিপুত্র, কনৌজ প্রভৃতি নগর। বাণিজ্যিক ও সুলভ পরিবহনের জন্যই নদী-তীরবর্তী অঞ্চলে এ-ধরনের গুরুত্বপূর্ণ শহর গড়ে উঠেছে।

(৩) তীর্থক্ষেত্র: 

        নদীর জলে পবিত্র হয়ে উপাসনা করার পরিপ্রেক্ষিতেই বেশিরভাগ তীর্থক্ষেত্র নদী-তীরবর্তী অঞ্চলে গড়ে উঠেছে। আর এই তীর্থক্ষেত্রকে কেন্দ্র করে হরিদ্বার, কাশী, মথুরা, প্রয়াগ, বৃন্দাবন প্রভৃতি তীর্থস্থান ও জনপদ গড়ে উঠেছে।

(৪) কৃষি-অর্থনীতি ও বাণিজ্যের বিকাশ: 

       উর্বর শস্য-শ্যামলা নদী-উপত্যকা ভারতীয় কৃষি-অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে। আর জলপথে পরিবহনের সুবিধার জন্যই নদী-তীরবর্তী অঞ্চলে বাণিজ্যকেন্দ্রগুলি গড়ে উঠেছে; যেমন- তাম্রলিপ্ত, পাটলিপুত্র, সপ্তগ্রাম প্রভৃতি নগর।

(৫) বিভিন্ন রাজশক্তির উদ্ভব: 

        ভারতীয় নদী-উপত্যকাগুলিতেই বিভিন্ন রাজবংশের উদ্ভব লক্ষ করা যায়। গোদাবরী, তুঙ্গাভদ্রা, কাবেরী প্রভৃতি নদী-উপত্যকায় চোল, পল্লব, রাষ্ট্রকূট প্রভৃতি রাজশক্তিগুলির উদ্ভব ঘটে।

(৬) ঐক্যের বন্ধন: 

      নদনদীগুলি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে অঞ্চলগুলিকে ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। আর, তাই কোনো কোনো ভারতবাসীর ঈশ্বর-আরাধনার ক্ষেত্রে আচমন মন্ত্রে গঙ্গা, যমুনা, সিন্ধু, কাবেরী, গোদাবরী প্রভৃতি নদনদীর নাম একত্রে উচ্চারিত হয়।

মন্তব্য: 

     এভাবে বহু ছোটো-বড়ো নদনদী ভারতের কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য বিকাশে প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। সমৃদ্ধ হয়েছে ভারতের কৃষি ও শিল্প অর্থনীতি, আর উন্নত হয়েছে ভারতীয় শিল্প-সংস্কৃতি।

নৃতত্ত্বের যাদুঘর: 

           ভারতবর্ষের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের মতো তার মানবীয় বৈচিত্র্যও যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য। যুগ যুগ ধরে ভারতবর্ষের বুকে বহু জা`তিগোষ্ঠীর আগমন ঘটেছে। ভারতবর্ষে প্রথম দ্রাবিড় জাতি এক উন্নত সভ্যতা গড়ে তোলে। এরপর গ্রিক, পারসিক, শক, হুণ, কুষাণ, তুর্কি, আফগান, ওলন্দাজ, ফরাসি, ইংরেজ ইত্যাদি বহু জাতিগোষ্ঠী ভারতবর্ষে এসেছেন। তাঁদের অনেকেই স্থায়ীভাবে ভারতবর্ষে থেকে গিয়েছেন। ভারতবর্ষ পরিণত হয়েছে বিভিন্ন জাতির মিলনক্ষেত্রে। তাই, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতবর্ষকে 'মহামানবের সাগরতীর' বলে অভিহিত করেছেন। ভিনসেন্ট স্মিথ ভারতবর্ষকে আবার 'নৃতত্ত্বের যাদুঘর" বা "Ethnological museum" বলে বর্ণনা করেছেন।

ভারতবর্ষের নানা ভাষা, নানা জাতি, নানা পরিধান, নানা মত বর্তমান; তবুও সব বিরোধের মাঝে আছে ঐক্যের অমোঘ বন্ধন। ভাবগত, সংস্কৃতিগত, ধর্মগত, শিক্ষাগত ও রাজনৈতিক ঐকোর মাঝে আছে অন্তরের ঐক্য। আর এ-কারণেই ভারতবর্ষ মহান।

ইতিহাসের উপাদান: 

           ভারতবর্ষের বৈচিত্র্য ও ঐক্যের মাঝে ঐতিহাসিক গ্রন্থের দৈন্যতা বড়ো বেশি প্রকট। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের বক্তব্য এ-বিষয়ে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন-হেরোডোটাস, থুকিডিডিস, লিভি বা ট্যাসিটাস-এর মতো কোনো ঐতিহাসিক না-থাকায় ভারতীয় ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন উপাদানের উপর বেশি নির্ভর করতে হয়। তাই, ভারতীয় ইতিহাস রচনায় সাহিত্য, বৈদেশিক বিবরণ, সরকারি দলিল দস্তাবেজ, সংবাদপত্র, মুদ্রা, শিলালিপি, স্থাপত্য, ভাস্কর্য প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। 

প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের উপাদান

             ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার-এর মতে, প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস রচনায় ভারতীয়গণ তেমন কোনো ভূমিকা নেয়নি (the Indians displayed a strange indifference towards properly recording the public events of their country-R.C. Majumdar)। প্রাচীন গ্রিস বা রোমের ইতিহাস রচনায় হেরোডটাস, খুকিডিডিস, পলিবিয়াস বা লিভি যে ধরনের মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন, ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে তেমন কোনো ইতিহাস গ্রন্থ রচিত হয়নি। এ-কারণে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস রচনায় বিভিন্ন নিদর্শন বা উপাদানের ওপর নির্ভর করতে হয়। 
ইতিহাসের এই উপাদানগুলিকে মূলত দু-ভাগে ভাগ করা যায়- (ক) সাহিত্য, (খ) প্রত্নতত্ত্ব। 
প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলিকে আবার তিনভাগে ভাগ করা যায়- (১) লিপি, (২) মুদ্রা, (৩) স্থাপত্য ও ভাস্কর্য।

Comments

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

ভরা কোটাল ও মরা কোটালের পার্থক্য

  ভরা কোটাল ও মরা কোটালের পার্থক্য Sl. No. ভরা কোটাল মরা কোটাল 1 চাঁদ, পৃথিবী ও সূর্য একই সরল রেখায় অবস্থান করলে চাঁদ ও সূর্যের মিলিত আকর্ষণ পৃথিবীর একই স্থানের উপর কার্যকরী হয়, ফলে ভরা কোটালের সৃষ্টি হয়। চাঁদ, পৃথিবী ও সূর্য সমকোণী অবস্থানে থাকলে পৃথিবীর উপর চাঁদ ও সূর্যের আকর্ষণ পরস্পর বিপরীত ও বিরোধী হয়, ফলে মরা কোটালের সৃষ্টি হয়। 2 মানবজীবনের উপর ভরা কোটালে (নদী-মোহানা, নৌ-চলাচল, মাছ আহরণ ইত্যাদি)-র প্রভাব বেশি। মানবজীবনের উপর মরা কোটালের প্রভাব কম। 3 ভরা কোটাল হয় অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে। মরা কোটাল হয় শুক্ল ও কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে। 4 ভরা কোটালের ক্ষেত্রে সাগর-মহাসাগরের জলতল সবচেয়ে বেশী স্ফীত হয়। মরা কোটালের ক্ষেত্রে সাগর-মহাসাগরের জলতলের স্ফীতি সবচেয়ে কম হয়। 5 অমাবস্যা তিথিতে পৃথিবীর একই পাশে একই সরলরেখায় চাঁদ ও সূর্য অবস্থান করে। পূর্ণিমা তিথিতে সূর্য ও চাঁদের মাঝে পৃথিবী একই সরলরেখায় অবস্থান করে। কৃষ্ণ ও শুক্ল পক্ষের অষ্টমীত...

ঘূর্ণবাত ও প্রতীপ ঘর্ণবাত-এর পার্থক্য

  ঘূর্ণবাত ও প্রতীপ ঘর্ণবাত-এর পার্থক্য Sl. No. ঘূর্ণবাত প্রতীপ ঘূর্ণবাত 1 ঘূর্ণবাতের নিম্নচাপ কেন্দ্রের চারিদিকে থাকে বায়ুর উচ্চচাপ বলয়। প্রতীপ ঘূর্ণবাতের উচ্চচাপ কেন্দ্রের চারিদিকে থাকে বায়ুর নিম্নচাপ বলয়। 2 নিম্নচাপ কেন্দ্রে বায়ু উষ্ণ, হালকা ও ঊর্ধ্বগামী হয়। উচ্চচাপ কেন্দ্রে বায়ু শীতল, ভারী ও নিম্নগামী হয়। 3 ঘূর্ণবাত দ্রুত স্থান পরিবর্তন করে, ফলে বিস্তীর্ণ অঞ্চল অল্প সময়ে প্রভাবিত হয়। প্রতীপ ঘূর্ণবাত দ্রুত স্থান পরিবর্তন করে না। 4 ঘূর্ণবাতের প্রভাবে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে এবং বজ্রবিদ্যুৎসহ প্রবল ঝড়-বৃষ্টি হয়। প্রতীপ ঘূর্ণবাতের প্রভাবে আকাশ মেঘমুক্ত থাকে। বৃষ্টিপাত ও ঝড়-ঝঞ্ঝা ঘটে না। মাঝেমাঝে তুষারপাত ও কুয়াশার সৃষ্টি হয়৷ 5 ঘূর্ণবাতের কেন্দ্রে নিম্নচাপ বিরাজ করে। প্রতীপ ঘূর্ণবাতের কেন্দ্রে উচ্চচাপ বিরাজ করে। 6 চারিদিক থেকে ঘূর্ণবাতের কেন্দ্রের দিকে বায়ু ছুটে আসে অর্থাৎ বায়ুপ্রবাহ কেন্দ্রমুখী। প্রতীপ ঘূর্ণবাতে কেন...

মানব জীবনের ওপর পর্বতের প্রভাব উল্লেখ করো।

মানব জীবনের ওপর পর্বতের প্রভাব উল্লেখ করো। সমুদ্র সমতল থেকে অন্তত ১০০০ মিটারের বেশি উঁচু ও বহুদূর বিস্তৃত শিলাময় স্তূপ যার ভূপ্রকৃতি অত্যন্ত বন্ধুর, ভূমির ঢাল বেশ খাড়া এবং গিরিশৃঙ্গ ও উপত্যকা বর্তমান তাকে পর্বত বলে৷ খাড়াভাবে দাঁড়িয়ে থাকা এই পর্বত মানুষের জীবনকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে। মানবজীবনে পর্বতের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবগুলি হল—

স্থলবায়ু ও সমুদ্রবায়ুর মধ্যে পার্থক্য

  স্থলবায়ু ও সমুদ্রবায়ুর মধ্যে পার্থক্য Sl. No. স্থলবায়ু সমুদ্রবায়ু 1 স্থলবায়ু মূলত শীতল ও শুষ্ক প্রকৃতির হয়। সমুদ্রবায়ু মূলত উষ্ণ ও আর্দ্র প্রকৃতির হয়। 2 স্থলবায়ু প্রধানত রাত্রিবেলায় প্রবাহিত হয়। সমুদ্রবায়ু প্রধানত দিনেরবেলায় প্রবাহিত হয়। 3 সূর্যাস্তের পরবর্তী সময়ে এই বায়ুর প্রবাহ শুরু হয় ও রাত্রির শেষদিকে বায়ুপ্রবাহের বেগ বৃদ্ধি পায়। সূর্যোদয়ের পরবর্তী সময়ে এই বায়ুরপ্রবাহ শুরু হয় ও অপরাহ্নে বায়ুপ্রবাহে বেগ বৃদ্ধি পায়। 4 স্থলবায়ু উচ্চচাযুক্ত স্থলভাগ থেকে নিম্নচাপযুক্ত জলভাগের দিকে প্রবাহিত হয়। এই কারণে স্থলবায়ুকে উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর সঙ্গে তুলনা করা হয়। সমুদ্রবায়ু উচ্চচাপযুক্ত সমুদ্র থেকে নিম্নচাপযুক্ত স্থলভাগের দিকে প্রবাহিত হয়। এই কারণে সমুদ্রবায়ুকে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর সঙ্গে তুলনা করা হয়। 5 স্থলভাগের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হবার দরুন বেগ তুলনামূলক কম হয়ে থাকে। উন্মুক্ত সমুদ্রের ওপর দিয়ে দীর্ঘপথ প্রবাহিত হ...

নদীর উচ্চপ্রবাহে ক্ষয়কার্যের ফলে যে ভূমিরূপ গড়ে ওঠে, তার বর্ণনা দাও।

নদীর উচ্চপ্রবাহে ক্ষয়কার্যের ফলে যে ভূমিরূপ গড়ে ওঠে, তার বর্ণনা দাও।   অথবা,  একটি আদর্শ নদীর বিভিন্ন ক্ষয়কাজের ফলে গঠিত তিনটি ভূমিরূপের চিত্রসহ সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।  অথবা,  নদীপ্রবাহের যে-কোনও একটি অংশে নদীর কার্যের বিবরণ দাও।             উচ্চপ্রবাহ বা পার্বত্য প্রবাহে নদীর প্রধান কাজ হল ক্ষয় করা। এর সঙ্গে বহন ও অতি সামান্য পরিমান সঞ্চয়কার্য ও করে থাকে। পার্বত্য অঞ্চলে ভূমির ঢাল বেশি থাকে বলে এই অংশে নদীপথের ঢাল খুব বেশি হয়, ফলে নদীর স্রোতও খুব বেশি হয়। স্বভাবতই পার্বত্য অঞ্চলে নদী তার প্রবল জলস্রোতের সাহায্যে কঠিন পাথর বা শিলাখণ্ডকে ক্ষয় করে এবং ক্ষয়জাত পদার্থ ও প্রস্তরখণ্ডকে সবেগে বহনও করে। উচ্চ প্রবাহে নদীর এই ক্ষয়কার্য প্রধানত চারটি প্রক্রিয়ার দ্বারা সম্পন্ন হয়।  এই প্রক্রিয়া গুলি হলো - অবঘর্ষ ক্ষয়, ঘর্ষণ ক্ষয়, জলপ্রবাহ ক্ষয় ও দ্রবণ ক্ষয়।  নদীর ক্ষয়কাজের ফলে বিভিন্ন ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়, যেমন: (১) ইংরেজি "।" এবং "V" অক্ষরের মতো নদী উপত্যকা:       পার্বত্য গতিপথের প্রথম অবস্থায় প্রবল বেগে নদী তার গতিপথের ...

দেশীয় ভাষা সংবাদপত্র আইন (১৮৭৮ খ্রি.)

দেশীয় ভাষা সংবাদপত্র আইন প্রবর্তন সাম্রাজ্যবাদী গভর্নর–জেনারেল লর্ড লিটন দেশীয় পত্রপত্রিকার কণ্ঠরোধ করার সিদ্ধান্ত নেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে দেশীয় ভাষা সংবাদপত্র আইন (Vernacular Press Act, 1878) জারি করেন। পটভূমি ঊনবিংশ শতকে দেশীয় সংবাদপত্রগুলিতে সরকারি কর্মচারীদের অন্যায় আচরণ, অর্থনৈতিক শোষণ, দেশীয় সম্পদের বহির্গমন, দেশীয় শিল্পের অবক্ষয় ইত্যাদি নানা বিষয় তুলে ধরা হয়। ইতিহাসবিদ এ.আর.দেশাইয়ের মতে, “ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিকাশে সংবাদপত্র হল এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম”।

ষাঁড়াষাঁড়ি বান

ষাঁড়াষাঁড়ি বান              বর্ষাকালে স্বাভাবিক কারণেই নদীতে জলের পরিমাণ ও বেগ বেশি থাকে। এই সময় জোয়ারের জল নদীর    মোহানায় প্রবেশ করলে জোয়ার ও নদীস্রোত—এই বিপরীতমুখী দুই স্রোতের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এর ফলে নদীর জল প্রবল শব্দ সহকারে প্রচণ্ড স্ফীত হয়ে ওঠে।  

প্রশান্ত মহাসাগরীয় আগ্নেয় মেখলা

প্রশান্ত মহাসাগরীয় আগ্নেয় মেখলা ‘মেখলা’ শব্দের মানে হল ‘কোমর বন্ধনী’। অসংখ্য আগ্নেয়গিরি মেখলা বা কোমর বন্ধনীর আকারে কোনো বিস্তীর্ণ অঞ্চলে যখন অবস্থান করে, তখন তাকে ‘আগ্নেয় মেখলা’ বলা হয়। ভূবিজ্ঞানীর মতে, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশীয় পাতের সঙ্গে ও এশীয় মহাদেশীয় পাতের সঙ্গে প্রশান্ত মহাসাগরীয় পাতের ক্রমাগত সংঘর্ষের ফলে পাত সীমায় ফাটল বরাবর অগ্ন্যুৎপাত ঘটে থাকে এবং আগ্নেয়গিরির সৃষ্টি হয়। 

গ্রস্ত উপত্যকা

গ্রস্ত উপত্যকা দুটি চ্যুতির মধ্যবর্তী অংশ বসে গেলে যে অবনমিত অঞ্চলের সৃষ্টি হয়, তাকে গ্রস্ত উপত্যকা বলে। এছাড়া, মহীভাবক আলোড়নের ফলে ভূপৃষ্ঠে সংকোচন ও প্রসারণ বলের সৃষ্টি হয়। যার ফলে ভূপৃষ্ঠের কঠিন শিলায় ফাটলের সৃষ্টি হয়। পরবর্তীকালে পুনরায় ভূ-আন্দোলন ঘটলে বা ভূ-আলোড়নের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে ফাটল রেখা বরাবর শিলার একটি অংশ অপর অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, একে চ্যুতি বলে। সংনমন বল বৃদ্ধি পেলে দুটি চ্যুতির মাঝের অংশ খাড়াভাবে নীচে বসে যায়। অবনমিত, ওই অংশকে বলে গ্রস্ত উপত্যকা। 

জাতীয়তাবাদের বিকাশে বঙ্কিমচন্দ্রের অবদান কী ?

          বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮–৯৪ খ্রি.) ছিলেন ঊনবিংশ শতকের অগ্রণী ঔপন্যাসিক ও প্রবন্ধকার। বঙ্কিমচন্দ্রের অধিকাংশ উপন্যাসের বিষয়বস্তু ছিল স্বদেশ ও দেশপ্রেম। বঙ্কিমচন্দ্রের সৃষ্টি ভারতীয় জাতীয়তাবোধের বিকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল। তাঁর ‘বন্দেমাতরম্’–মন্ত্র ছিল বিপ্লবীদের বীজমন্ত্র। অরবিন্দ ঘোষ তাই বঙ্কিমকে ‘জাতীয়তাবোধের ঋত্বিক’ বলেছেন।