ভারত-ইতিহাসে সমুদ্রের প্রভাব ভারত-ইতিহাসে সমুদ্রের প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সুদূরপ্রসারী। সমুদ্র ভারতের কেবল ভৌগোলিক সীমানাই নির্ধারণ করেনি, বরং এর সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি এবং বিশ্ব-সম্পর্কের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। ভারতবর্ষের তিনদিক সমুদ্রবেষ্টিত। তাই, ভারত-ইতিহাসে সমুদ্রের প্রভাব থাকাটাই স্বাভাবিক ঘটনা। (১) তিনদিক সমুদ্রবেষ্টিত হওয়ায় তিন দিকের সীমান্ত বেশ সুরক্ষিত। (২) আবার এই সমুদ্রপথ ধরেই আমাদের দেশের সঙ্গে চিন, রোম, মালয়, সুমাত্রা, জাভা, সিংহল ও পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। (৩) এমনকি এই জলপথের মাধ্যমেই রাজনৈতিক প্রাধান্য স্থাপিত হয়েছে।
ভারত-ইতিহাসে সমুদ্রের প্রভাব
ভারত-ইতিহাসে সমুদ্রের প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সুদূরপ্রসারী। সমুদ্র ভারতের কেবল ভৌগোলিক সীমানাই নির্ধারণ করেনি, বরং এর সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি এবং বিশ্ব-সম্পর্কের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। ভারতবর্ষের তিনদিক সমুদ্রবেষ্টিত। তাই, ভারত-ইতিহাসে সমুদ্রের প্রভাব থাকাটাই স্বাভাবিক ঘটনা।
(১) তিনদিক সমুদ্রবেষ্টিত হওয়ায় তিন দিকের সীমান্ত বেশ সুরক্ষিত।
(২) আবার এই সমুদ্রপথ ধরেই আমাদের দেশের সঙ্গে চিন, রোম, মালয়, সুমাত্রা, জাভা, সিংহল ও পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
ভারত মহাসাগরের প্রভাব:
বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছাড়াও বৈদেশিক আধিপত্য স্থাপনে ভারত মহাসাগর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। ভারত মহাসাগরের আর্দ্র বাতাস পূর্বঘাট পর্বতমালায় বাধাপ্রাপ্ত হয়ে চেন্নাই অঞ্চলের ভূমিকে সিক্ত করে ওই স্থানকে শস্য-শ্যামলা করেছে।
বঙ্গোপসাগরের প্রভাব:
'পেরিপ্লাস অফ দি ইরিথ্রিয়ান সি' নামক গ্রন্থ থেকে খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের ভারতীয় সামুদ্রিক বাণিজ্যের তথ্য পাই। এসময় 'তাম্রলিপ্ত বন্দর' (বর্তমানে মেদিনীপুর জেলায়) বৈদেশিক বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। চোলগণ তাঁদের নৌ-আধিপত্যের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরকে 'চোল হ্রদ'-এ পরিণত করেছিলেন।
অর্থনীতি ও বাণিজ্য (Trade and Economy)
প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত সমুদ্র ভারতের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি।
অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য:
ভারতের সুদীর্ঘ উপকূলরেখা (প্রায় 7500 কিলোমিটার) অসংখ্য বন্দর গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। এই বন্দরগুলি দিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম উভয় দিকেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চলত।
পশ্চিম উপকূল:
এখানে লোথাল (প্রাচীন), সুরাট, ক্যাম্বে, কোচিন এবং আধুনিক মুম্বাইয়ের মতো বন্দরগুলি দিয়ে রোম, মেসোপটেমিয়া, আরব ও আফ্রিকার সঙ্গে মসলা, বস্ত্র, রত্নপাথর ইত্যাদির বাণিজ্য হতো।
পূর্ব উপকূল:
তাম্রলিপ্ত (প্রাচীন), আরিকামেডু, এবং পরে চেন্নাইয়ের মতো বন্দর দিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া (সুবর্ণভূমি বা ইন্দোনেশিয়া), চীন ও শ্রীলঙ্কার সাথে বাণিজ্য চলত।
সম্পদ আহরণ:
সমুদ্র মৎস্য, মুক্তা এবং লবণ আহরণের মতো জীবিকার উৎস সরবরাহ করেছে।
সাংস্কৃতিক বিস্তার ও ধর্মীয় প্রভাব (Cultural Expansion and Religion)
সমুদ্রপথ ভারতীয় সংস্কৃতি, ধর্ম ও ভাষার বিস্তারে সহায়ক হয়েছিল। এই প্রক্রিয়াকে সাধারণত বৃহত্তর ভারত (Greater India) বলা হয়।
ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিস্তার:
ভারতীয় বণিক, ধর্মপ্রচারক এবং ভ্রমণকারীরা সমুদ্রপথ ব্যবহার করে বৌদ্ধধর্ম, হিন্দুধর্ম, সংস্কৃত ভাষা ও ভারতীয় শিল্পকলা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে (যেমন ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া) ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, কম্বোডিয়ার আঙ্করভাট এবং ইন্দোনেশিয়ার বোরোবুদুর স্তূপ ভারতীয় স্থাপত্য ও ধর্মের প্রভাব বহন করে।
বিদেশী সংস্কৃতির আগমন:
সমুদ্রপথ দিয়েই বিদেশী সংস্কৃতিও ভারতে এসেছে। আরব বণিকদের মাধ্যমে ইসলাম ধর্মের প্রাথমিক বিস্তার ঘটেছিল পশ্চিম উপকূলের বন্দরগুলিতে, যা ভারতের সাংস্কৃতিক মিশ্রণে অবদান রাখে।
রাজনীতি ও প্রতিরক্ষা (Politics and Defence)
সমুদ্র প্রাচীন ও মধ্যযুগে ভারতকে সুরক্ষা দিলেও আধুনিক যুগে তা আক্রমণকারীদের প্রবেশপথ হয়ে ওঠে।
প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা:
স্থলভাগের মতো সরাসরি বৃহৎ আক্রমণ থেকে সমুদ্র একসময় ভারতের উপদ্বীপীয় অংশকে সুরক্ষা দিত।
সামুদ্রিক শক্তি:
বিভিন্ন ভারতীয় রাজবংশ, যেমন চোল রাজারা, শক্তিশালী নৌ-বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। চোলরা সমুদ্রপথে শ্রীলঙ্কা, মালয় ও সুমাত্রার মতো অঞ্চলে অভিযান চালিয়ে সামুদ্রিক আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন।
ঔপনিবেশিক শাসন:
আধুনিক যুগে সমুদ্র ছিল ইউরোপীয় শক্তির (পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ইংরেজ, ফরাসি) ভারতে প্রবেশের প্রধান পথ। ইংরেজদের শক্তিশালী নৌ-বাহিনী (Royal Navy) সমুদ্রপথে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেই ভারতে ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল।
ভূ-কৌশলগত গুরুত্ব (Geo-Strategic Importance)
ভারত মহাসাগরের কেন্দ্রে ভারতের অবস্থান ভূ-রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
উপদ্বীপীয় অবস্থান:
ভারত মহাসাগরের উপর ভারতের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার সুবিধা রয়েছে, যা এই অঞ্চলকে সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে।
আধুনিক নিরাপত্তা:
বর্তমানে ভারতের নৌ-বাহিনী দেশের সামুদ্রিক স্বার্থ এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (EEZ) রক্ষা করার পাশাপাশি ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এই সমুদ্রপথেই এসেছিল পোর্তুগিজ, ওলন্দাজ, দিনেমার, ফরাসি ও ইংরেজ জাতি। তাদের আগমনে ভারতবর্ষে যেমন আধুনিকতার মুক্ত হাওয়া বয়ে গিয়েছিল, তেমনি প্রায় ২০০ বছরের ইংরেজদের অধীনে পরাধীনতার গ্লানিও ভারতীয়দের সহ্য করতে হয়েছিল।

Comments
Post a Comment