নব্যবঙ্গ আন্দোলনের সূচনা ও উদ্দেশ্য - হিন্দু কলেজের অধ্যাপক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর নেতৃত্বে নব্যবঙ্গীয়রা সমাজকে কুসংস্কারমুক্ত করতে চেয়েছিলেন। তবে এই কাজ করতে গিয়ে বেশকিছু বাড়াবাড়ি করে ফেলায় তাঁদের সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। নব্যবঙ্গ আন্দোলন দ্রুত ভেঙে পড়ার কারণ— সহজাত কিছু ত্রুটির জন্য নব্যবঙ্গ আন্দোলন দ্রুত স্তিমিত হয়ে পড়ে। এখানে কয়েকটি ত্রুটি তুলে ধরা হলো —
ভারতের ইতিহাসে বিন্ধ্যপর্বতের প্রভাব
ভারতের ইতিহাসে এবং ভূগোলে বিন্ধ্যপর্বত কেবল একটি পর্বতমালা নয়, বরং এটি উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের মধ্যে একটি প্রাকৃতিক প্রাচীর বা বিভাজিকা হিসেবে কাজ করেছে। ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে এর প্রভাব অপরিসীম।
নিচে ভারতের ইতিহাসে বিন্ধ্যপর্বতের প্রভাব আলোচনা করা হলো:
১. ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক বিভাজিকা
বিন্ধ্যপর্বত ভারতকে প্রধানত দুটি ভাগে বিভক্ত করেছে:
আর্যাবর্ত (উত্তর ভারত):
বিন্ধ্যের উত্তরাংশ, যা সিন্ধু-গঙ্গা সমভূমি ও হিমালয় অঞ্চল নিয়ে গঠিত।
দাক্ষিণাত্য (দক্ষিণ ভারত):
বিন্ধ্যের দক্ষিণাংশ, যা উপদ্বীপীয় ভারত নামে পরিচিত।
প্রাচীন ও মধ্যযুগে এই পর্বতমালা উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্যে বাধা সৃষ্টি করেছিল। উত্তর ভারতের কোনো সম্রাটের পক্ষে (যেমন—মৌর্য, গুপ্ত বা মোগল) বিন্ধ্য অতিক্রম করে দীর্ঘকাল দক্ষিণ ভারত শাসন করা কঠিন ছিল। একইভাবে, দক্ষিণ ভারতের রাজশক্তিগুলোর (যেমন—রাষ্ট্রকূট বা চোল) পক্ষেও উত্তরে দীর্ঘস্থায়ী আধিপত্য বিস্তার করা সহজ ছিল না।
২. সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষা
বিন্ধ্যপর্বত একটি দুর্গম বাধা হওয়ায় উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের সংস্কৃতি স্বতন্ত্রভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে:
ভাষা ও সাহিত্য:
উত্তরে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা (সংস্কৃত ও তার থেকে উদ্ভূত ভাষাসমূহ) এবং দক্ষিণে দ্রাবিড় ভাষা গোষ্ঠী (তামিল, তেলুগু, কন্নড়, মালয়ালম) প্রাধান্য পেয়েছে।
স্থাপত্যরীতি:
উত্তরে ‘নগর’ শৈলী এবং দক্ষিণে ‘দ্রাবিড়’ শিল্পরীতির মন্দির স্থাপত্যের বিকাশ ঘটেছে। বিন্ধ্যের বাধার কারণেই দক্ষিণের সংস্কৃতিতে উত্তরের প্রভাব সহজে গ্রাস করতে পারেনি।
৩. বহিরাগত আক্রমণ থেকে রক্ষা
ভারতের ইতিহাসে অধিকাংশ বৈদেশিক আক্রমণ (আর্য, হুন, শক, তুর্কি, মোগল) উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে হয়েছে। বিন্ধ্যপর্বত এবং তৎসংলগ্ন ঘন অরণ্য দক্ষিণ ভারতকে এই নিরবচ্ছিন্ন আক্রমণ ও লুটতরাজ থেকে অনেকটা সুরক্ষিত রেখেছিল। ফলে উত্তর ভারত যখন রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে গেছে, দক্ষিণ ভারত তখন তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল ছিল এবং নিজস্ব কৃষ্টি-কালচার ধরে রাখতে পেরেছিল।
৪. আদিবাসী ও জনজাতিদের আশ্রয়স্থল
বিন্ধ্যপর্বত ও তার সংলগ্ন অরণ্য অঞ্চল প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন আদিবাসী ও জনজাতি গোষ্ঠীর (যেমন—ভিল, গোণ্ড, কোল) নিরাপদ আশ্রয়স্থল। যখনই সমতলে শক্তিশালী সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটেছে, তখন মূলস্রোতের বাইরে থাকা এই জনগোষ্ঠীগুলো বিন্ধ্যের দুর্গম অঞ্চলে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
৫. ঋষি অগস্ত্য ও সাংস্কৃতিক মিলন
ইতিহাস ও পুরাণের মিশেলে ঋষি অগস্ত্যের বিন্ধ্য পর্বত অতিক্রম করার কাহিনীটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। মনে করা হয়, ঋষি অগস্ত্যই প্রথম বিন্ধ্য অতিক্রম করে দাক্ষিণাত্যে আর্য সংস্কৃতি বা বৈদিক ধর্ম প্রচার করেন। এটি উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। অর্থাৎ, বাধা হলেও বিন্ধ্য একেবারে অলঙ্ঘ্য ছিল না।
বিন্ধ্যপর্বত ভারতের ইতিহাসে একটি ‘দেয়াল’ হিসেবে কাজ করলেও তা কখনোই উত্তর ও দক্ষিণকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করেনি। বরং এটি ভারতের 'বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য' (Unity in Diversity) গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে, যেখানে দুটি ভিন্ন ধারা পাশাপাশি বিকশিত হয়েও একে অপরের পরিপূরক হয়েছে।
একনজরে বিন্ধ্যপর্বতের প্রভাব:
(১) দাক্ষিণাত্যে 'দ্রাবিড় সভ্যতা'-র বিকাশ ঘটেছে।
(২) বিকশিত হয়েছে উন্নত ও মৌলিক শিল্প-স্থাপত্য।
(৩) সেইসলো ঢোল-শিল্প, চালুক্য-শিল্প, চান্দের- শিল্প প্রভৃতি দ্রাবিড় সভ্যতার অঙ্গ হিসাবে গড়ে উঠেছে।
(৪) ক্রমে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, সমুদ্রগুপ্ত, আলাউদ্দিন খলজি, আকবর প্রমুখ পরাক্রমশালী নৃপতিবর্গ আর্যাবর্ত ও দাক্ষিণাত্যের অধীশ্বর হয়। ফলে, ধীরে ধীরে ভারতবর্ষের দুই প্রান্তের মধ্যে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্য গড়ে ওঠে। জন্ম নেয়-মিশ্র সংস্কৃতির ভারতবর্ষ।

Comments
Post a Comment