ইতিহাসের উপাদান বলতে কী বোঝো? ইতিহাসের উপাদানগুলির শ্রেণিবিভাগ করো। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় মুদ্রার গুরুত্ব বিস্তারিত আলোচনা করো। ১. ইতিহাসের উপাদান ইতিহাস হলো মানব সভ্যতার অগ্রগতির ধারাবাহিক বিবরণ। কিন্তু এই বিবরণ কল্পনাপ্রসূত নয়; এটি নির্ভর করে সুনির্দিষ্ট তথ্য ও প্রমাণের ওপর। যে সমস্ত উৎস, সাক্ষ্য বা প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে ঐতিহাসিকরা অতীত দিনের ঘটনাবলী পুনর্গঠন করেন, তাকেই 'ইতিহাসের উপাদান' (Sources of History) বলা হয়। উপাদান ছাড়া ইতিহাস রচনা করা অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার শামিল। ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ বা আর. সি. মজুমদার সকলেই একমত যে, প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের ক্ষেত্রে উপাদানের গুরুত্ব অপরিসীম। ২. ইতিহাসের উপাদানের শ্রেণিবিভাগ (Classification of Historical Sources) ইতিহাসের উপাদানগুলিকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়— (ক) সাহিত্যিক উপাদান এবং (খ) প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান। তবে আধুনিক যুগে এর সাথে আরও কিছু বিষয় যুক্ত হয়েছে। নিচে এর বিস্তারিত দেওয়া হলো: ক) সাহিত্যিক উপাদান (Literary Sources):...
ইতিহাসের উপাদান বলতে কী বোঝো? ইতিহাসের উপাদানগুলির শ্রেণিবিভাগ করো। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় মুদ্রার গুরুত্ব বিস্তারিত আলোচনা করো।
ইতিহাসের উপাদান বলতে কী বোঝো? ইতিহাসের উপাদানগুলির শ্রেণিবিভাগ করো। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় মুদ্রার গুরুত্ব বিস্তারিত আলোচনা করো।
১. ইতিহাসের উপাদান
ইতিহাস হলো মানব সভ্যতার অগ্রগতির ধারাবাহিক বিবরণ। কিন্তু এই বিবরণ কল্পনাপ্রসূত নয়; এটি নির্ভর করে সুনির্দিষ্ট তথ্য ও প্রমাণের ওপর। যে সমস্ত উৎস, সাক্ষ্য বা প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে ঐতিহাসিকরা অতীত দিনের ঘটনাবলী পুনর্গঠন করেন, তাকেই 'ইতিহাসের উপাদান' (Sources of History) বলা হয়। উপাদান ছাড়া ইতিহাস রচনা করা অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার শামিল। ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ বা আর. সি. মজুমদার সকলেই একমত যে, প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের ক্ষেত্রে উপাদানের গুরুত্ব অপরিসীম।
২. ইতিহাসের উপাদানের শ্রেণিবিভাগ (Classification of Historical Sources)
ইতিহাসের উপাদানগুলিকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়—
(ক) সাহিত্যিক উপাদান এবং
(খ) প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান।
তবে আধুনিক যুগে এর সাথে আরও কিছু বিষয় যুক্ত হয়েছে। নিচে এর বিস্তারিত দেওয়া হলো:
ক) সাহিত্যিক উপাদান (Literary Sources):
১. দেশীয় সাহিত্য:
❀ধর্মীয় সাহিত্য:
বেদ, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত (বৈদিক যুগ), ত্রিপিটক ও জাতক (বৌদ্ধ যুগ), এবং অঙ্গ ও উপাঙ্গ (জৈন যুগ)।
❀ধর্মনিরপেক্ষ বা লৌকিক সাহিত্য:
জীবনীগ্রন্থ (হর্ষচরিত, রামচরিত), নাটক ও কাব্য (কালিদাসের মেঘদূত, বিশাখদত্তের মুদ্রারাক্ষস), ব্যাকরণ (পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী), এবং বিজ্ঞান ও রাজনীতি বিষয়ক গ্রন্থ (কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র)।
❀সঙ্গম সাহিত্য:
দক্ষিণ ভারতের ইতিহাস জানতে তামিল সঙ্গম সাহিত্য অপরিহার্য।
২. বৈদেশিক বিবরণী:
❀গ্রিক ও রোমান:
মেগাস্থিনিসের 'ইন্ডিকা', প্লিনির 'ন্যাচারাল হিস্ট্রি', টলেমির 'ভূগোল'।
❀চীনা:
ফা-হিয়েন, হিউয়েন সাং ও ইৎ-সিং-এর ভ্রমণবৃত্তান্ত।
❀আরবীয়:
আল-বিরুনি, আল-মাসুদির বিবরণ।
খ) প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান (Archaeological Sources):
সাহিত্যের ত্রুটি বা অতিরঞ্জন দূর করতে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান সবথেকে নির্ভরযোগ্য। একে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়—
১. লিপি বা লেখ (Inscriptions): অশোকের লিপি, এলাহাবাদ প্রশস্তি ইত্যাদি।
২. মুদ্রা (Coins): কুষাণ, গুপ্ত ও ইন্দো-গ্রিক মুদ্রা।
৩. স্থাপত্য ও ভাস্কর্য (Monuments): মন্দির, স্তূপ, ঘরবাড়ি, প্রাচীন নগরের ধ্বংসাবশেষ (হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো)।
গ) আধুনিক উপাদান:
সরকারি দলিল-দস্তাবেজ, পুলিশ রিপোর্ট, আত্মজীবনী, চিঠি এবং সমসাময়িক সংবাদপত্র।
৩. প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় মুদ্রার গুরুত্ব (Importance of Coins/Numismatics)
প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পুনর্গঠনে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলির মধ্যে মুদ্রা বা ‘Numismatics’-এর গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষত যেসব যুগের কোনো লিখিত বা সাহিত্যিক প্রমাণ পাওয়া যায় না, সেই যুগের ইতিহাস জানতে মুদ্রাই একমাত্র ভরসা। মুদ্রার গুরুত্বকে আমরা নিম্নলিখিত কয়েকটি প্রধান শিরোনামে আলোচনা করতে পারি:
(১) রাজনৈতিক ইতিহাস ও বংশতালিকা পুনর্গঠন:
প্রাচীন ভারতের বহু রাজবংশের কোনো ধারাবাহিক ইতিহাস সাহিত্যে পাওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে মুদ্রাই সেই শূন্যস্থান পূরণ করে।
ইন্দো-গ্রিক বা ব্যাক্ট্রীয় গ্রিক:
ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে রাজত্বকারী ব্যাক্ট্রীয় গ্রিক রাজাদের ইতিহাস প্রায় পুরোটাই মুদ্রা-নির্ভর। মুদ্রার সাহায্য ছাড়া ডিমিট্রিয়াস, মিনান্ডার বা ইউক্রেটাইডিস-এর মতো প্রায় ৩০ জন গ্রিক রাজার নাম ও অস্তিত্ব আমাদের অজানা থেকে যেত।
কুষাণ ও শক:
শক ও কুষাণ রাজাদের বংশতালিকা তৈরি করতে মুদ্রা প্রধান ভূমিকা নিয়েছে। 'রাজা', 'মহারাজা', 'রাজাধিরাজ' প্রভৃতি উপাধি দেখে তাঁদের রাজনৈতিক ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা করা যায়।
(২) কালনির্ণয় বা তারিখ নির্ধারণ (Chronology):
ইতিহাসে তারিখ বা সাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রাচীন বহু মুদ্রার গায়ে রাজার নাম এবং রাজ্যাভিষেকের বছর বা 'শকাব্দ' ও 'বিক্রমাব্দ'-এর উল্লেখ থাকে।
এর ফলে ঐতিহাসিকরা রাজাদের রাজত্বকালের সঠিক সময়সীমা নির্ধারণ করতে পারেন।
উদাহরণস্বরূপ, শক ক্ষত্রপ ও কুষাণ রাজাদের রাজত্বকাল এবং গুপ্ত রাজাদের সময়কাল নির্ধারণে মুদ্রায় খোদাই করা তারিখ বা সংবৎ অত্যন্ত সহায়ক হয়েছে।
(৩) অর্থনৈতিক অবস্থার দর্পণ (Economic History):
মুদ্রা হলো তৎকালীন অর্থনীতির ব্যারোমিটার।
ধাতুর মান:
মুদ্রায় ব্যবহৃত সোনা, রুপো বা তামার পরিমাণ দেখে সেই যুগের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বোঝা যায়। যেমন—গুপ্ত যুগের প্রথমদিকের স্বর্ণমুদ্রা (দিনার) ছিল নিখাদ, যা প্রমাণ করে সাম্রাজ্য তখন সমৃদ্ধ ছিল। কিন্তু পরবর্তী গুপ্ত রাজাদের (যেমন স্কন্দগুপ্তের পরবর্তী সময়ে) মুদ্রায় খাদ বা ভেজালের পরিমাণ বেড়ে যায়, যা অর্থনীতির অবক্ষয়ের ইঙ্গিত দেয়।
বাণিজ্যিক সম্পর্ক:
ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রচুর পরিমাণে রোমান স্বর্ণমুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে প্রাচীন ভারতের সঙ্গে রোমান সাম্রাজ্যের এক বিশাল ও লাভজনক বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল।
(৪) সাম্রাজ্যের সীমানা নির্ধারণ (Geographical Extent):
কোনো নির্দিষ্ট রাজার মুদ্রা মাটির নিচে যেসব অঞ্চল থেকে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়, ধরে নেওয়া হয় যে সেই অঞ্চলগুলি ওই রাজার সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল অথবা সেখানে তাঁর বাণিজ্যিক প্রভাব ছিল।
যেমন—সাতবাহন রাজাদের মুদ্রা দাক্ষিণাত্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পাওয়া গেছে, যা তাঁদের বিশাল সাম্রাজ্যের প্রমাণ দেয়।
সমুদ্রগুপ্ত ও চন্দ্রগুপ্তের মুদ্রা বাংলা থেকে পাঞ্জাব পর্যন্ত পাওয়া গেছে, যা গুপ্ত সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি নির্দেশ করে।
(৫) ধর্মীয় বিশ্বাস ও ধর্মনিরপেক্ষতা (Religious History):
রাজারা কোন দেবতার উপাসক ছিলেন, তা মুদ্রায় খোদাই করা দেবদেবীর মূর্তি দেখে বোঝা যায়।
কুষাণ যুগ:
কুষাণ সম্রাট কনিষ্কের মুদ্রায় বুদ্ধ, শিব, এবং গ্রিক ও পারসিক দেবতাদের মূর্তি দেখা যায়। এটি প্রমাণ করে যে তিনি পরধর্মসহিষ্ণু ছিলেন এবং তাঁর রাজ্যে বিভিন্ন ধর্মের সহাবস্থান ছিল।
গুপ্ত যুগ:
গুপ্ত সম্রাটদের মুদ্রায় লক্ষ্মী, গরুড়, কার্তিক প্রভৃতির মূর্তি প্রমাণ করে তাঁরা বৈষ্ণব বা শৈব ধর্মের অনুরাগী ছিলেন। প্রথম চন্দ্রগুপ্তের মুদ্রায় 'লক্ষ্মীদেবী'র মূর্তি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
(৬) শিল্পকলা ও সংস্কৃতির পরিচয় (Art and Culture):
মুদ্রার গায়ে খোদাই করা চিত্রগুলি তৎকালীন ভাস্কর্য ও শিল্পকলার উৎকৃষ্ট নিদর্শন।
সমুদ্রগুপ্তের মুদ্রা:
সমুদ্রগুপ্তের একটি মুদ্রায় তাঁকে পালঙ্ক বা চেয়ারে বসে ‘বীণা বাদনরত’ অবস্থায় দেখা যায়। এটি প্রমাণ করে যে তিনি কেবল একজন মহান যোদ্ধাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন সঙ্গীতজ্ঞ ও সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ।
পোশাক-পরিচ্ছদ:
কুষাণ মুদ্রায় রাজাদের লম্বা কোট, বুট জুতো ও শিরস্ত্রাণ পরিহিত মূর্তি দেখে তৎকালীন বিদেশী রাজাদের পোশাক সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
(৭) ব্যক্তিগত গুণাবলী ও ঐতিহাসিক ঘটনা:
মুদ্রা অনেক সময় বিশেষ ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখে।
বিবাহ ও রাজনীতি:
প্রথম চন্দ্রগুপ্ত ও লিচ্ছবি রাজকন্যা কুমারদেবীর নামাঙ্কিত 'চন্দ্রগুপ্ত-কুমারদেবী' মুদ্রা প্রমাণ করে যে, গুপ্তরা লিচ্ছবিদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছিলেন।
অশ্বমেধ যজ্ঞ:
সমুদ্রগুপ্ত ও প্রথম কুমারগুপ্তের 'অশ্বমেধ পরাক্রম' লেখা মুদ্রা প্রমাণ করে যে তাঁরা বৈদিক অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন।
(৮) ভাষাতাত্ত্বিক গুরুত্ব:
মুদ্রায় উৎকীর্ণ লিপি থেকে তৎকালীন ভাষা ও লিপি সম্পর্কে জানা যায়। যেমন—ইন্দো-গ্রিক মুদ্রায় একদিকে গ্রিক এবং অন্যদিকে খরোষ্ঠী লিপির ব্যবহার দেখা যায়, যা দ্বিভাষিক সংস্কৃতির পরিচয় দেয়।
সীমাবদ্ধতা (Limitations)
এত গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও মুদ্রার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে:
১. স্থানান্তর:
মুদ্রা ছোট ও বহনযোগ্য হওয়ায় বাণিজ্যের মাধ্যমে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলে যেতে পারে। তাই শুধুমাত্র মুদ্রাপ্রাপ্তির স্থানের ওপর ভিত্তি করে সাম্রাজ্যের সীমানা নির্ধারণ করা অনেক সময় বিভ্রান্তিকর হতে পারে।
২. জাল মুদ্রা:
প্রাচীনকালেও জাল মুদ্রার প্রচলন ছিল, যা ঐতিহাসিক তথ্যকে ভুল পথে চালিত করতে পারে।
উপসংহার ও মন্তব্য
পরিশেষে বলা যায়, প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের বহু অন্ধকারময় অধ্যায় আলোকিত করতে মুদ্রার ভূমিকা অপরিসীম। বিশেষ করে খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে খ্রিষ্টাব্দ চতুর্থ শতক পর্যন্ত ভারতের ইতিহাসের প্রধান ভিত্তিই হলো মুদ্রা। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার (R.C. Majumdar) যথার্থই বলেছেন:
"The coins have preserved the names of additional kings and given us particulars about the locality over which they ruled." (মুদ্রা অনেক অজানা রাজার নাম সংরক্ষণ করেছে এবং তাঁরা কোন অঞ্চলে রাজত্ব করতেন সে সম্পর্কে আমাদের তথ্য দিয়েছে।)
তাই ইতিহাস রচনায় সাহিত্য ও শিলালিপির পাশাপাশি মুদ্রাও এক অপরিহার্য এবং বিজ্ঞানসম্মত উপাদান।

Comments
Post a Comment