প্রাচীন ভারতের জনগোষ্ঠী বা জাতিতত্ত্ব ভারতের বিশাল ভূখণ্ডে যুগে যুগে নানা জাতি ও উপজাতির আগমন ঘটেছে। এই মহামিলনের ফলেই গড়ে উঠেছে ভারতের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি। ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ (V.A. Smith) তাই যথার্থই ভারতকে 'নৃতত্ত্বের জাদুঘর' (Ethnological Museum) বলে অভিহিত করেছেন।
প্রাচীন ভারতের জনগোষ্ঠী বা জাতিতত্ত্ব
ভারতের বিশাল ভূখণ্ডে যুগে যুগে নানা জাতি ও উপজাতির আগমন ঘটেছে। এই মহামিলনের ফলেই গড়ে উঠেছে ভারতের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি। ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ (V.A. Smith) তাই যথার্থই ভারতকে 'নৃতত্ত্বের জাদুঘর' (Ethnological Museum) বলে অভিহিত করেছেন।
নৃতাত্ত্বিক শ্রেণিবিভাগ
১৯৩১ সালের আদমশুমারির ওপর ভিত্তি করে বিশিষ্ট নৃতত্ত্ববিদ ড. বি.এস. গুহ (Dr. B.S. Guha) ভারতীয় জনগোষ্ঠীকে প্রধানত ৬টি ভাগে ভাগ করেছেন। নিচে তাদের পরিচয় দেওয়া হলো:
১. নেগ্রিটো (The Negrito):
এরাই ভারতের আদিমতম অধিবাসী বলে মনে করা হয়। এদের গায়ের রং কালো, চুল কোঁকড়ানো, ঠোঁট পুরু এবং উচ্চতা কম।
বর্তমান অবস্থান:
বর্তমানে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ এবং দক্ষিণ ভারতের কিছু আদিবাসী গোষ্ঠীর (যেমন—কাদের, ইকুলা) মধ্যে এদের অস্তিত্ব টিকে আছে।
২. প্রোটো-অস্ট্রালয়ড বা আদি-অস্ট্রাল (The Proto-Australoid):
নেগ্রিটোদের পরেই এরা ভারতে আসে। সিন্ধু সভ্যতা ও পরবর্তী ভারতীয় সংস্কৃতি গড়ে তোলায় এদের বড় অবদান রয়েছে। এদের গায়ের রং কালো এবং নাক চ্যাপ্টা।
বর্তমান অবস্থান:
মধ্য ভারতের কোল, ভিল, মুণ্ডা, সাঁওতাল প্রভৃতি উপজাতিরা এই গোষ্ঠীর অন্তর্গত।
৩. মোঙ্গলীয় (The Mongoloid):
এদের গায়ের রং পীত বা হলদেটে, মুখমন্ডল চ্যাপ্টা এবং দাড়ি-গোঁফ কম। এরা মূলত উত্তর ও উত্তর-পূর্ব ভারত দিয়ে প্রবেশ করেছিল।
বর্তমান অবস্থান:
হিমালয়ের পাদদেশ, আসাম, নেপাল, ও উত্তর-পূর্ব ভারতের উপজাতিরা (যেমন—নাগা, গারো, লেপচা) এই গোষ্ঠীর বংশধর।
৪. ভূমধ্যসাগরীয় বা মেডিটারেনিয়ান (The Mediterranean):
এই গোষ্ঠীটি ভারতীয় সভ্যতার বিকাশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এদের তিনটি উপভাগ আছে। এদের মধ্যে উন্নত অংশটি 'দ্রাবিড়' নামে পরিচিত। সিন্ধু সভ্যতা এদেরই সৃষ্টি বলে মনে করা হয়।
বর্তমান অবস্থান:
দক্ষিণ ভারতের তামিল, তেলুগু, কন্নড় ও মালয়ালি ভাষাভাষী মানুষ মূলত এই গোষ্ঠীর অন্তর্গত।
৫. পাশ্চাত্য গোলমুণ্ড বা ওয়েস্টার্ন ব্রাকিফেলাস (Western Brachycephals):
এদের মাথা চওড়া ও গোল। এরা অ্যালপাইন, ডিনারিক ও আর্মেনয়ড—এই তিন শাখায় বিভক্ত।
বর্তমান অবস্থান:
গুজরাট, মহারাষ্ট্র, কুর্গ এবং বিশেষত বাঙালিদের মধ্যে এই গোষ্ঠীর সংমিশ্রণ সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।
৬. নর্ডিক বা আর্য (The Nordic):
এরা সবার শেষে ভারতে আসে। এরা লম্বা, গায়ের রং ফর্সা এবং সুঠাম দেহের অধিকারী। এরা উত্তর-পশ্চিম ভারত দিয়ে প্রবেশ করে এবং বৈদিক সভ্যতার সূচনা করে।
বর্তমান অবস্থান:
পাঞ্জাব, রাজস্থান এবং উত্তর ভারতের উচ্চবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে এদের প্রভাব বেশি।
প্রাচীনকাল থেকে শক, হুণ, কুষাণ, মোগল, পাঠানসহ নানা জাতি এই ছয়টি মূল ধারার সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে। রক্তের এই সংমিশ্রণের ফলেই ভারতীয় মহাজাতি আজ এক অবিচ্ছেদ্য সত্তায় পরিণত হয়েছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'ভারততীর্থ' কবিতায় এই ঐতিহাসিক সত্যকেই তুলে ধরেছেন—
"হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীন— শক-হুণ-দল পাঠান-মোগল এক দেহে হল লীন।"

Comments
Post a Comment