হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীদের সামাজিক জীবনের বিস্তারিত পরিচয় (A detailed introduction to the social life of the inhabitants of the Harappan civilization)
🗿 হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীদের সামাজিক জীবনের বিস্তারিত পরিচয়
হরপ্পা সভ্যতা বা সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের সামাজিক জীবন সম্পর্কে জানার প্রধান উৎস হলো প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত নগর পরিকল্পনা, সমাধিক্ষেত্র, মৃৎপাত্র, মূর্তি, অলংকার এবং অন্যান্য নিদর্শনসমূহ। এই নিদর্শনের ভিত্তিতে সমাজবিজ্ঞানীরা হরপ্পা সমাজের নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলি তুলে ধরেছেন:
১. সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস এবং ক্ষমতা কাঠামো
নগর পরিকল্পনার দ্বিখণ্ডিত কাঠামো (দুর্গ এলাকা ও নিম্নাঞ্চল) এবং বিভিন্ন প্রকারের বসতবাড়ির আকারভেদে সমাজে শ্রেণিবিন্যাস ছিল বলে অনুমান করা হয়।
শ্রেণিবিভাজন: ঐতিহাসিক দামোদর ধর্মানন্দ কোশাম্বীর মতো পণ্ডিতেরা মনে করেন, হরপ্পা সমাজকে প্রধানত চারটি স্তরে ভাগ করা যেত:
শাসক ও পুরোহিতগোষ্ঠী: এরা সম্ভবত দুর্গ এলাকায় বসবাস করতেন এবং প্রশাসনিক ও ধর্মীয় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। মহেন-জো-দারোর 'পুরোহিতের মূর্তি' (Priest King) এদের উপস্থিতির ইঙ্গিত দেয়।
যোদ্ধা বা সামরিক শ্রেণি: সমাজে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং বাণিজ্যপথ সুরক্ষিত রাখার জন্য বেতনভুক্ত যোদ্ধা সম্প্রদায় ছিল। গর্ডন চাইল্ড মনে করেন, অভিজাত শাসকশ্রেণি ধাতু নির্মিত ভারী অস্ত্রের জোরে সমাজে অন্য সকলকে দমিয়ে রাখত।
বণিক, কারিগর ও ভূস্বামী: এরা ছিলেন সমাজের মধ্যবিত্ত বা বিত্তশালী অংশ। আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের জন্য বণিকরা সমাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন।
শ্রমিক, চাষি ও দীনদরিদ্র: এরা নিম্নাঞ্চলের প্রান্তে খুপরি জাতীয় কামরায় বাস করত এবং কৃষি ও দৈনন্দিন শ্রমের মাধ্যমে সমাজের ভিত্তি তৈরি করত। হরপ্পায় শস্যাগারের পাশে শ্রমিকদের কোয়ার্টারের অস্তিত্ব এর প্রমাণ।
ক্ষমতা কাঠামো: এই সমাজে পুরোহিতদের প্রভাব ছিল না সামরিক শক্তির প্রভাব—তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে নগর পরিকল্পনার শৃঙ্খলা দেখে অনুমান করা যায়, এখানে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় প্রশাসন বা পৌরসংস্থা বিদ্যমান ছিল।
২. সমাজ ও পরিবারের প্রকৃতি
মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা: সিন্ধু উপত্যকার বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য পোড়ামাটির নারীমূর্তি (Terracotta Figurines) আবিষ্কৃত হয়েছে। এই মূর্তিগুলির বিপুল আধিক্য দেখে ঐতিহাসিকদের (যেমন: এ. এল. ব্যাসাম) অনুমান যে, হরপ্পা সমাজে সম্ভবত মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রচলিত ছিল অথবা মাতৃদেবী বা উর্বরতা দেবীর পূজা অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল।
পরিবার: বাড়ির আকার এবং বিন্যাস দেখে মনে করা হয় যে এখানে একান্নবর্তী বা যৌথ পরিবার প্রথা প্রচলিত ছিল। প্রতিটি বাড়িতেই কেন্দ্রীয় উঠোন, স্নানাগার ও কুয়োর উপস্থিতি ছিল।
৩. পোশাক-পরিচ্ছদ, অলংকার ও প্রসাধন
পোশাক: উৎখননের ফলে পাওয়া মানবমূর্তি (যেমন: 'পুরোহিত মূর্তি') এবং প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে অনুমান করা হয় যে, নারী ও পুরুষ উভয়েই দু-খণ্ড বস্ত্র ব্যবহার করত:
শরীরের নিম্নাংশে ধুতি বা স্কার্টের মতো পোশাক।
শরীরের ঊর্ধ্বাংশে শাল বা চাদরের মতো আবরণ, যা বাঁ কাঁধের ওপর দিয়ে ডান হাতের নিচ পর্যন্ত ঝোলানো থাকত।
বস্ত্রের উপকরণ: পোশাকের জন্য প্রধানত সুতি (কার্পাস) এবং পশম (বিশেষত শীতকালে) ব্যবহৃত হতো। সিন্ধু সভ্যতার মানুষই প্রথম তুলা চাষ শুরু করেছিল বলে মনে করা হয়।
অলংকার: এই সভ্যতাবাসী নারী-পুরুষ উভয়েই অলংকার ব্যবহার করত।
নারীদের অলংকার: চুড়ি, কানের দুল, হার, কোমরবন্ধ, আংটি, নুপুর ইত্যাদি।
পুরুষদের অলংকার: আঙুলে আংটি ও গলায় হার পরার চল ছিল।
উপাদান: ধনীরা সোনা, রূপা, হাতির দাঁত ও মূল্যবান পাথর (যেমন: কার্নেলিয়ান) দিয়ে তৈরি অলংকার পরত। দরিদ্ররা তামা, শঙ্খ এবং পোড়ামাটির অলংকার ব্যবহার করত।
প্রসাধন: চান-হু-দারো-তে প্রসাধন সামগ্রীর কারখানা আবিষ্কৃত হয়েছে। লিপস্টিক, কাজল, তামা বা ব্রোঞ্জের তৈরি আয়না ও চিরুনির ব্যবহার ছিল।
৪. খাদ্যাভ্যাস ও জীবিকা
প্রধান জীবিকা: হরপ্পাবাসীদের প্রধান জীবিকা ছিল কৃষি, পশুপালন, উন্নত কারিগরি শিল্প এবং অভ্যন্তরীণ ও বহির্বাণিজ্য। লোথাল-এ প্রাপ্ত ডকইয়ার্ড বা পোতাশ্রয় বাণিজ্যের গুরুত্ব প্রমাণ করে।
খাদ্যাভ্যাস: তারা শস্য এবং আমিষ উভয় প্রকার খাদ্য গ্রহণ করত।
শস্য: গম, যব (বার্লি), ধান (বিশেষত লোথাল ও রঙ্গপুরে প্রমাণ মেলে), ডাল, সরিষা ও তিল।
অন্যান্য: ফলমূল (যেমন: খেজুর), দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য।
আমিষ: মাছ, কচ্ছপের মাংস, ভেড়া, শূকর ও মুরগির মাংস খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
৫. বিনোদন ও খেলাধুলা
সামাজিক জীবনে বিনোদনের গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল।
অভ্যন্তরীণ বিনোদন: পাশা খেলা (Dice Game) ছিল অন্যতম জনপ্রিয় খেলা, যার প্রমাণ হিসেবে প্রত্নতাত্ত্বিকরা পাশার গুটি আবিষ্কার করেছেন।
খোলা বিনোদন: নাচ-গান (মহেন-জো-দারোর 'নৃত্যরতা বালিকার মূর্তি' এর প্রমাণ), পশুশিকার, মাছ ধরা এবং ষাঁড়ের লড়াই ছিল তাদের অন্যতম বিনোদনের মাধ্যম।
শিশুদের খেলনা: পোড়ামাটির তৈরি ছোট ছোট পশুর মডেল, সিটি, চাকার গাড়ি ইত্যাদি খেলনা আবিষ্কৃত হয়েছে।
৬. শেষকৃত্য (Funeral Practices)
সমাধিক্ষেত্রগুলি সামাজিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিক প্রকাশ করে। হরপ্পাবাসীরা মূলত তিনটি পদ্ধতিতে শেষকৃত্য করত:
সম্পূর্ণ সমাধি (Complete Burial): মৃতদেহকে উত্তর-দক্ষিণ দিকে রেখে কবরে শুইয়ে দেওয়া হতো। কবরের সঙ্গে মৃৎপাত্র, অলংকার ও অন্যান্য সামগ্রীও দেওয়া হতো, যা পরজন্মের বিশ্বাসকে ইঙ্গিত করে।
আংশিক সমাধি (Partial Burial): মৃতদেহকে পশু-পাখির খাদ্যের জন্য রেখে দেওয়ার পর অবশিষ্ট হাড়গোড় সংগ্রহ করে সমাধি দেওয়া হতো।
দাহকার্য (Cremation): মৃতদেহকে দাহ করার পর ভস্মাবশেষ পাত্রে রেখে কবর দেওয়া হতো।
🎯 উপসংহার
হরপ্পা সভ্যতার সামাজিক জীবন ছিল যথেষ্ট উন্নত, সংগঠিত এবং বিলাসিতামূলক। সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস ছিল সুস্পষ্ট, যেখানে শাসকগোষ্ঠী প্রশাসনিক ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিল। মাতৃতান্ত্রিক সমাজের ইঙ্গিত, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার উপর জোর (উন্নত স্যানিটেশন) এবং সমৃদ্ধ জীবনযাত্রার প্রমাণ (পোশাক ও অলংকার) থেকে বোঝা যায় যে, এই সভ্যতা একটি বুর্জোয়া (Bourgeois) সভ্যতার ছাপ বহন করত, যেমনটি মার্টিমার হুইলার উল্লেখ করেছেন। প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ এই সমাজকে প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ ও সুশৃঙ্খল সমাজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

Comments
Post a Comment