হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনার বিশদ বিবরণ (Details of the city planning of the Harappan civilization)
🧱 হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনার বিশদ বিবরণ
হরপ্পা সভ্যতা (আনুমানিক ২৬০০ - ১৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ), যা সিন্ধু সভ্যতা নামেও পরিচিত, প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম উন্নত এবং সুপরিকল্পিত নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা। হরপ্পা, মহেন-জো-দারো, লোথাল, কালিবঙ্গান এবং ধোলাভিরা-এর মতো স্থানগুলিতে খননকার্যের ফলে যে নগর পরিকল্পনা উন্মোচিত হয়েছে, তা এই সভ্যতার প্রকৌশল ও পৌর প্রশাসনের দক্ষতা প্রমাণ করে। এটি সমসাময়িক মিশরীয় বা মেসোপটেমীয় সভ্যতার নগর পরিকল্পনা থেকেও অনেক বেশি সুশৃঙ্খল ও আধুনিক ছিল।
হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনার নিম্নলিখিত প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি লক্ষ্যণীয়:
১. সুনির্দিষ্ট দ্বিখণ্ডিত নগর এলাকা (The Twin Settlement Plan)
অধিকাংশ হরপ্পা নগরীর একটি সুনির্দিষ্ট দ্বিখণ্ডিত কাঠামো ছিল, যা নগর প্রশাসন ও সামাজিক বিভাজনের স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়।
পশ্চিমে দুর্গ এলাকা (Citadel Area): এটি অপেক্ষাকৃত উঁচু টিলার ওপর তৈরি হত এবং সাধারণত ছোট এলাকা নিয়ে গঠিত ছিল। এই অংশটি পুরু ইটের প্রাচীর দ্বারা সুরক্ষিত ছিল।
ব্যবহার: এখানে শাসকশ্রেণী বা কর্তাব্যক্তিরা বাস করতেন। এছাড়া, গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ও সম্ভবত ধর্মীয় কাঠামো, যেমন মহেন-জো-দারোর মহা-স্নানাগার ও শস্যাগার, এই দুর্গ এলাকাতেই আবিষ্কৃত হয়েছে। এই প্রাচীর নির্মাণ প্রমাণ করে যে নিরাপত্তার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া হতো।
পূর্বে নিম্নাঞ্চল (Lower Town): এটি অপেক্ষাকৃত বড় এবং নিচু এলাকায় অবস্থিত ছিল।
ব্যবহার: এখানে সাধারণ নাগরিক, কারিগর এবং ব্যবসায়ীরা বাস করতেন। বাড়িগুলি গ্রিড-প্যাটার্নে সুশৃঙ্খলভাবে বিন্যস্ত ছিল।
ব্যতিক্রম: লোথালে পুরো শহরটিই একটি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল, যেখানে দুর্গ এবং নিম্নাঞ্চল আলাদাভাবে প্রাচীরবেষ্টিত ছিল না। আবার, ধোলাভিরাতে শহরটি তিনটি অংশে বিভক্ত ছিল (দুর্গ, মধ্যম শহর এবং নিম্নাঞ্চল)।
২. জ্যামিতিক গ্রিড ব্যবস্থা ও রাজপথ (The Grid System and Roads)
হরপ্পা নগর পরিকল্পনার সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যমূলক দিক হলো এর জ্যামিতিক গ্রিড ব্যবস্থা।
রাস্তা বিন্যাস: শহরের প্রধান রাস্তাগুলি (৯ ফুট থেকে ৩৪ ফুট পর্যন্ত চওড়া) উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিম বরাবর একে অপরের সাথে সমকোণে ছেদ করত। এর ফলে গোটা শহরটিই ছোট-বড় আয়তাকার খণ্ডে (ব্লকে) বিভক্ত হয়ে যেত।
সুবিধা: এই ব্যবস্থা বায়ু চলাচলের সুবিধা দিত এবং শহরকে দ্রুত পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করত। এটিকে ‘চেকার বোর্ড’ বা ‘গ্রিড প্যাটার্ন’ পরিকল্পনা বলা হয়।
আলোর ব্যবস্থা: রাজপথের দু-পাশে সারিবদ্ধভাবে প্রদীপ বা লণ্ঠন রাখার ব্যবস্থা ছিল, যা রাতের বেলায় নাগরিকদের সুবিধা দিত।
গলি পথ: মূল রাস্তাগুলি ছাড়াও বাড়িগুলির মাঝে সরু গলি পথ ছিল, যার সঙ্গে বাড়ির দরজা সংযুক্ত থাকত।
৩. উন্নত পয়ঃপ্রণালী ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা (The Advanced Drainage System)
পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা ছিল হরপ্পা সভ্যতার শ্রেষ্ঠ অর্জন, যা নাগরিক স্বাস্থ্যবিধি ও পরিচ্ছন্নতার প্রতি তাদের সচেতনতা প্রমাণ করে।
বাড়ির নর্দমা: প্রতিটি বাড়ির স্নানঘর ও শৌচাগারের নোংরা জল পোড়া মাটির তৈরি নল বা ছোট নালা দিয়ে নিষ্কাশিত হয়ে পাশের সরু গলির নালাতে পড়ত।
প্রধান নর্দমা: গলির নালাগুলি শহরের প্রধান রাস্তার পাশে থাকা বড়, ঢাকা নর্দমার সঙ্গে যুক্ত ছিল। এই নর্দমাগুলি সাধারণত পোড়া ইট এবং চুন-সুরকি দিয়ে তৈরি ছিল এবং slab বা ইট দিয়ে ঢাকা থাকত।
পরিষ্কারের ব্যবস্থা: নর্দমাগুলিতে নির্দিষ্ট দূরত্বে ম্যানহোল বা পরিদর্শনের ছিদ্র (Inspection Hole) রাখা হতো, যাতে প্রয়োজনে নর্দমা পরিষ্কার করা যায়।
নিষ্কাশন: শহরের সমস্ত নোংরা জল একটি প্রধান নর্দমার মাধ্যমে শহরের বাইরে জনবসতিহীন এলাকায় নিষ্কাশিত হতো।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব: ড. এ. এল. ব্যাসামের মতো ঐতিহাসিকেরা মন্তব্য করেছেন যে, রোমান সভ্যতার উত্থানের আগে বিশ্বের অন্য কোনো প্রাচীন সভ্যতায় এত উন্নত ও সুসংগঠিত পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা আবিষ্কৃত হয়নি।
৪. নির্মাণ সামগ্রী ও স্থাপত্যশৈলী (Building Materials and Architecture)
ইট ব্যবহার: হরপ্পা সভ্যতার নগরগুলির একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল পোড়া ইটের (Baked Bricks) ব্যাপক ব্যবহার। ইটগুলি ছিল সুনির্দিষ্ট ও মানসম্মত মাপের (সাধারণত ৪:২:১ অনুপাতে), যা উচ্চমানের প্রকৌশল জ্ঞান প্রমাণ করে। কালিবঙ্গানে অবশ্য রোদ-শুকানো ইটের ব্যবহার দেখা যায়।
আবাসিক কাঠামো:
বৈচিত্র্য: ধনী-দরিদ্রের জন্য একতলা থেকে দোতলা-তিনতলা পর্যন্ত বিভিন্ন আকারের বাড়ি পাওয়া গেছে।
পরিকল্পনা: প্রতিটি বাড়িতে সাধারণত একটি খোলা উঠোন (Courtyard), শোয়ার ঘর, রান্নাঘর, স্নানঘর এবং ব্যক্তিগত কুয়ো (Wells) থাকত।
গোপনীয়তা: বেশিরভাগ বাড়ির দরজা-জানালা সদর রাস্তার দিকে না রেখে পাশের সরু গলির দিকে রাখা হতো, যা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বজায় রাখার প্রতি গুরুত্ব দিত।
শ্রমিকদের আবাস: শহরের নিম্নাঞ্চলের একেবারে শেষ প্রান্তে বা গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণস্থলের কাছে খুপরি জাতীয় ছোট কামরাগুলির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, যেখানে শ্রমিক বা দরিদ্র মানুষেরা বাস করত।
৫. গুরুত্বপূর্ণ সরকারি বা গণ-কাঠামো (Public Structures)
হরপ্পা সভ্যতায় সুনির্দিষ্ট প্রশাসনিক কাঠামোর ইঙ্গিত দিতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ গণ-স্থাপত্যের সন্ধান মিলেছে:
মহা-স্নানাগার (The Great Bath): মহেন-জো-দারোর দুর্গ এলাকায় আবিষ্কৃত এই সুবিশাল কাঠামোটি (প্রায় ১২ মি x ৭ মি x ২.৪ মি) সম্ভবত ধর্মীয় বা আনুষ্ঠানিক স্নানের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতো। এটি নিখুঁত জলরোধী (water-tight) কাঠামো ছিল। মার্টিমার হুইলার এর ধর্মীয় ব্যবহারের ওপর জোর দিয়েছেন।
শস্যাগার (Granaries): হরপ্পা ও মহেন-জো-দারোতে আবিষ্কৃত বিশাল শস্যাগার বা শস্য মজুত করার স্থানগুলি ছিল শহরের আবশ্যকীয় খাদ্যের মজুত ভান্ডার। হরপ্পার শস্যাগারগুলির পাশে শ্রমিকদের ছোট আবাস থাকার প্রমাণ মিলেছে। এই শস্যাগারগুলি সম্ভবত কেন্দ্রীয় প্রশাসনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো।
সভাকক্ষ/কলেজ (Assembly Hall/College): মহেন-জো-দারোতে স্তম্ভযুক্ত একটি বিশাল হল-এর সন্ধান পাওয়া গেছে, যা সম্ভবত প্রশাসনিক আলোচনা বা ধর্মীয় জমায়েতের জন্য ব্যবহৃত হতো।
৬. বন্দরের প্রমাণ (Evidence of Ports - লোথাল)
গুজরাটের লোথালে একটি সুপরিকল্পিত কৃত্রিম ডকইয়ার্ড (Dockyard) বা পোতাশ্রয়ের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে, যা এই সভ্যতার সমুদ্র-বাণিজ্যের গুরুত্ব প্রমাণ করে। এর গঠনশৈলী দেখায় যে এটি জোয়ারের জল ধরে রাখার জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছিল।
🎯 পরিসমাপ্তি ও বিশ্লেষণ
হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনা ছিল এক সুশৃঙ্খল, মানসম্মত এবং অত্যন্ত প্রগতিশীল ব্যবস্থা। এর প্রধান সাফল্যগুলি ছিল:
মানসম্মত নির্মাণ: ইট এবং অন্যান্য নির্মাণ উপাদানের সুনির্দিষ্ট ও অভিন্ন মাপের ব্যবহার।
পৌর প্রশাসন: এত উন্নত নগর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি শক্তিশালী, শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং দক্ষ পৌরসংস্থা বা কেন্দ্রীয় প্রশাসনের উপস্থিতি অনিবার্য ছিল।
স্বাস্থ্য সচেতনতা: উন্নত পয়ঃপ্রণালী ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা তাদের নাগরিক স্বাস্থ্যবিধির প্রতি উচ্চ সচেতনতা প্রতিফলিত করে।
এই নগর পরিকল্পনা কেবল বাসস্থান নির্মাণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তা ছিল একটি সুসংগঠিত সমাজ, শক্তিশালী প্রশাসন এবং উন্নত প্রযুক্তির সুস্পষ্ট প্রতিফলন। বিশ্বের প্রাচীন সভ্যতাগুলির ইতিহাসে হরপ্পা সভ্যতার এই নগর পরিকল্পনা একটি অনন্য নজির হয়ে আছে।

Comments
Post a Comment