বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য ভারত-ইতিহাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এক মহাদেশের সারাংশ (Epitome of the World) ভারতবর্ষ শুধুমাত্র একটি দেশ নয়, এটি একটি উপ-মহাদেশের সমতুল্য। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য, নৃতাত্ত্বিক ভিন্নতা এবং সাংস্কৃতিক বিপুলতা সত্ত্বেও এই ভূখণ্ডের হাজার বছরের ইতিহাসে যে "অন্তর্নিহিত মৌলিক ঐক্য" ( Fundamental Unity ) বারবার প্রকাশিত হয়েছে, তা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে যথার্থই " India offers unity in diversity " বা "বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য" বলে আখ্যা দিয়েছেন। যুগে যুগে বিভিন্ন জাতি, ধর্ম ও ভাষাভাষী মানুষের মিলনকেন্দ্র হওয়ায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতবর্ষকে "মহামানবের সাগরতীর" নামে অভিহিত করেছেন। ভারতবর্ষের বৈচিত্র্যের স্বরূপ (The Nature of Diversity) ভারতের বৈচিত্র্যকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়: ক) প্রাকৃতিক বা ভৌগোলিক বৈচিত্র্য: ভূ-প্রকৃতি: উত্...
ঐতিহাসিক তথ্য সরবরাহে সাহিত্যকে কয়টি ভাগে ভাগ করা যায়? প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় দেশীয় সাহিত্যের অবদান বিস্তারিত আলোচনা করো।
ঐতিহাসিক তথ্য সরবরাহে সাহিত্যকে কয়টি ভাগে ভাগ করা যায়? প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় দেশীয় সাহিত্যের অবদান বিস্তারিত আলোচনা করো।
ইতিহাস হলো মানব সভ্যতার অগ্রগতির প্রামাণ্য দলিল। কিন্তু প্রাচীন ভারতে হেরোডোটাস বা থুকিডিডিসের মতো কোনো প্রথাগত ঐতিহাসিক ছিলেন না। এ কারণেই একসময় আল-বিরুনি মন্তব্য করেছিলেন যে, "ভারতীয়দের কোনো ইতিহাস চেতনা নেই।" কিন্তু এই ধারণা সম্পূর্ণ সত্য নয়। প্রাচীন ভারতের মুনি-ঋষি এবং কবিরা সরাসরি ইতিহাস না লিখলেও, তাঁদের রচিত বিপুল সাহিত্যরাশির মধ্যে ছড়িয়ে আছে ইতিহাসের মহামূল্যবান উপাদান। এই উপাদানগুলিকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে বিশ্লেষণ করলেই প্রাচীন ভারতের লুপ্ত ইতিহাস পুনরুদ্ধার করা সম্ভব।
ঐতিহাসিক সাহিত্যের শ্রেণিবিন্যাস (Classification of Literary Sources)
ঐতিহাসিকভাবে তথ্য সরবরাহের উৎসের ওপর ভিত্তি করে সাহিত্যিক উপাদানকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়:
(ক) দেশীয় সাহিত্য (Indigenous Literature):
ভারতীয় লেখকদের রচিত ধর্মগ্রন্থ, জীবনী ও অন্যান্য সাহিত্য।
(খ) বৈদেশিক বিবরণী (Foreign Accounts):
গ্রিক, রোমান, চীনা, তিব্বতীয় ও আরব পর্যটকদের বিবরণ।
প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় দেশীয় সাহিত্যের অবদান
প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় দেশীয় সাহিত্যই হলো প্রধান স্তম্ভ। আলোচনার সুবিধার্থে দেশীয় সাহিত্যকে প্রধানত চারটি ভাগে ভাগ করা যায়:
(ক) ধর্মীয় সাহিত্য
(খ) ধর্মনিরপেক্ষ বা লৌকিক সাহিত্য
(গ) জীবনচরিত বা আধা-ঐতিহাসিক সাহিত্য
(ঘ) আঞ্চলিক ইতিহাস ও রাজবংশাবলি
নিচে প্রতিটি ভাগের বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
(ক) ধর্মীয় সাহিত্য (Religious Literature)
প্রাচীন ভারতের মানুষের জীবন ছিল ধর্মকেন্দ্রিক। তাই ধর্মগ্রন্থগুলির পাতায় পাতায় জড়িয়ে আছে তৎকালীন সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতির চিত্র।
১. বৈদিক সাহিত্য:
ঋগ্বেদ:
এটি আর্যদের প্রাচীনতম গ্রন্থ। এখান থেকে আমরা 'দশরাাজার যুদ্ধ' (রাজনৈতিক), আর্যদের ভৌগোলিক বিস্তার (সপ্তসিন্ধু অঞ্চল), সভা ও সমিতির মতো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের কথা জানতে পারি।
পরবর্তী বৈদিক সাহিত্য:
সাম, যজু, অথর্ববেদ, ব্রাহ্মণ ও উপনিষদ থেকে আর্যদের গাঙ্গেয় উপত্যকায় বসতি স্থাপন, বর্ণপ্রথা এবং কৃষিনির্ভর অর্থনীতির বিবর্তন সম্পর্কে জানা যায়। সূত্র সাহিত্য (ধর্মসূত্র, গৃহ্যসূত্র) থেকে তৎকালীন আইন-কানুন ও বিবাহ রীতির পরিচয় পাওয়া যায়।
২. মহাকাব্য (রামায়ণ ও মহাভারত):
মহাকাব্য দুটিতে বর্ণিত ঘটনাগুলির ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, এগুলি থেকে আর্যদের দাক্ষিণাত্য অভিযান (রামায়ণ) এবং কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের (মহাভারত) মাধ্যমে এক বিশাল রাজনৈতিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এছাড়া তৎকালীন রাজতন্ত্র, সমাজ ব্যবস্থা ও নৈতিক আদর্শের পরিচয় এতে মেলে।
৩. পুরাণ:
১৮টি মহাপুরাণের মধ্যে মৎস্য, বায়ু, বিষ্ণু, ব্রহ্মাণ্ড ও ভাগবত পুরাণ ইতিহাসের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
রাজবংশাবলি:
পুরাণগুলিতে মৌর্য, শুঙ্গ, কান্ব, সাতবাহন এবং গুপ্ত রাজবংশের রাজাদের নাম ও বংশতালিকা দেওয়া আছে। ড. আর. সি. মজুমদার বলেন, "সাতবাহন বংশের ইতিহাস রচনার জন্য আমরা পুরাণের কাছে ঋণী।"
ভৌগোলিক তথ্য:
প্রাচীন ভারতের নদনদী, পাহাড় ও জনপদের বিবরণ পুরাণে পাওয়া যায়।
৪. বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্য:
ত্রিপিটক ও জাতক:
পালি ভাষায় রচিত বৌদ্ধ ত্রিপিটক এবং জাতকের গল্পগুলি থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার নিখুঁত ছবি পাওয়া যায়। বিশেষ করে 'অঙ্গুত্তর নিকায়' গ্রন্থ থেকে ষোড়শ মহাজনপদের (Sixteen Mahajanapadas) তালিকা ও পারস্পরিক দ্বন্দ্বে ইতিহাস জানা যায়।
জৈন গ্রন্থ:
'ভগবতী সূত্র', 'পরিশিষ্টপার্বণ' এবং 'কল্পসূত্র' থেকে মহাবীরের জীবন এবং মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সম্পর্কে বহু তথ্য জানা যায়।
(খ) ধর্মনিরপেক্ষ বা লৌকিক সাহিত্য (Secular Literature)
শুধুমাত্র ধর্ম নয়, প্রাচীন ভারতে রাজনীতি, বিজ্ঞান, ব্যাকরণ ও নাটক রচনার এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ছিল, যা ইতিহাসের উপাদান হিসেবে অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য।
১. অর্থশাস্ত্র (কৌটিল্য):
মৌর্য যুগের ইতিহাস জানার জন্য চাণক্য বা কৌটিল্য রচিত 'অর্থশাস্ত্র' হলো সর্বশ্রেষ্ঠ উপাদান। এতে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, গুপ্তচর প্রথা, রাজস্ব নীতি এবং 'সপ্তাঙ্গ মতবাদ' বিস্তারিতভাবে বর্ণিত আছে। এটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি মাস্টারপিস।
২. ব্যাকরণ গ্রন্থ:
অষ্টাধ্যায়ী:
পাণিনির এই ব্যাকরণ গ্রন্থ থেকে মৌর্য-পূর্ব ভারতের রাজনৈতিক সংঘ বা 'গণরাজ্য'গুলির কথা জানা যায়।
মহাভাষ্য:
পতঞ্জলি রচিত এই গ্রন্থে শুঙ্গ রাজাদের ইতিহাস এবং গ্রিক (যবন) আক্রমণের উল্লেখ পাওয়া যায়।
৩. নাটক ও কাব্য:
মুদ্রারাক্ষস:
বিশাখদত্তের এই নাটকে নন্দ বংশের উচ্ছেদ এবং চাণক্য ও চন্দ্রগুপ্তের কৌশলের নাটকীয় বর্ণনা আছে।
কালিদাসের রচনাবলি:
'রঘুবংশম', 'মালবিকাগ্নিমিত্রম' এবং 'অভিজ্ঞান শকুন্তলম' থেকে গুপ্ত যুগের স্বর্ণালি সংস্কৃতির পরিচয় এবং শুঙ্গ রাজা অগ্নিমিত্রের কথা জানা যায়।
মৃচ্ছকটিকম্:
শূদ্রকের লেখা এই নাটকে তৎকালীন বিচার ব্যবস্থা ও সামাজিক দুর্নীতির বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে।
(গ) জীবনচরিত বা আধা-ঐতিহাসিক সাহিত্য (Biographical Literature)
প্রাচীন ভারতের সভাকবিরা তাঁদের আশ্রয়দাতা রাজাদের প্রশস্তি বা গুণকীর্তন করে যেসব কাব্য রচনা করেছেন, সেগুলিকে জীবনচরিত বলা হয়। যদিও এতে অতিরঞ্জন থাকে, তবুও এগুলি ইতিহাসের অমূল্য রত্ন।
১. হর্ষচরিত:
বাণভট্ট রচিত এই গ্রন্থে সম্রাট হর্ষবর্ধনের বাল্যকাল, সিংহাসন আরোহণ, রাজ্যজয় এবং তৎকালীন থানেশ্বর ও কনৌজের রাজনৈতিক পরিস্থিতির বর্ণনা রয়েছে।
২. রামচরিত:
সন্ধ্যাকর নন্দী রচিত এই কাব্যে দ্ব্যর্থবোধক শ্লোকের মাধ্যমে একদিকে রামায়ণের রামচন্দ্র এবং অন্যদিকে পাল রাজা রামপালের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। এখান থেকেই আমরা বাংলায় 'কৈবর্ত বিদ্রোহ' এবং ভীম-এর বীরত্বের কথা জানতে পারি।
৩. বিক্রমাঙ্কদেবচরিত:
কাশ্মীরি কবি বিলহন এই কাব্যে চালুক্য রাজা ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের রাজ্যজয়ের কাহিনী বর্ণনা করেছেন।
৪. অন্যান্য:
বাকপতিরাজের 'গৌড়বহ' (কনৌজ রাজ যশোবর্মণের কাহিনী), পদ্মগুপ্তের 'নবসাহশাঙ্কচরিত', এবং জয়সিংহের 'কুমারপালচরিত' উল্লেখযোগ্য।
(ঘ) আঞ্চলিক ইতিহাস ও রাজবংশাবলি
ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয় ইতিহাস জানার জন্য কিছু বিশেষ গ্রন্থ রচিত হয়েছিল।
১. রাজতরঙ্গিনী (কাশ্মীরের ইতিহাস):
১১৫০ খ্রিস্টাব্দে কল্হন রচিত 'রাজতরঙ্গিনী' হলো প্রাচীন ভারতের একমাত্র গ্রন্থ যাকে আধুনিক অর্থে প্রকৃত ইতিহাস গ্রন্থ বলা যায়। এতে কাশ্মীরের রাজাদের ধারাবাহিক ইতিহাস, নিরপেক্ষ বিচার এবং কার্যকারণ সম্পর্ক নিরূপণের চেষ্টা করা হয়েছে। ঐতিহাসিক কোসাম্বী একে ইতিহাসের অমূল্য দলিল বলেছেন।
২. সঙ্গম সাহিত্য (দক্ষিণ ভারত):
তামিল ভাষায় রচিত বিপুল 'সঙ্গম সাহিত্য' (যেমন- শিলাপ্পাদিকরম, মণিমেখলাই) থেকে দক্ষিণ ভারতের চোল, চে, ও পাণ্ড্য রাজাদের ইতিহাস এবং তৎকালীন রোম-ভারত বাণিজ্যের সমৃদ্ধ ইতিহাস জানা যায়।
৩. গুজরাটের ইতিহাস:
'রাসমালা' ও 'প্রবন্ধচিন্তামণি' নামক গ্রন্থগুলি থেকে গুজরাটের রাজবংশের ইতিহাস জানা যায়।
৪. দেশীয় সাহিত্যের সীমাবদ্ধতা (Limitations)
এত গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও দেশীয় সাহিত্যের কিছু সীমাবদ্ধতা বা ত্রুটি রয়েছে:
কালপঞ্জির অভাব:
ভারতীয় সাহিত্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘটনার সঠিক সাল-তারিখ বা ক্রমানুসার (Chronology) পাওয়া যায় না।
অতিরঞ্জন:
সভাকবিরা রাজাদের সন্তুষ্ট করার জন্য প্রায়শই তাঁদের গুণাবলী বাড়িয়ে লিখতেন এবং দোষগুলি গোপন করতেন।
ধর্মীয় প্রভাব:
অধিকাংশ সাহিত্য ধর্মকে কেন্দ্র করে রচিত হওয়ায় তাতে অলৌকিক ও পৌরাণিক কাহিনীর প্রাধান্য বেশি, যা থেকে ইতিহাস পৃথক করা কঠিন।
পরিশেষে বলা যায়, প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় দেশীয় সাহিত্য এক বিশাল ও বৈচিত্র্যময় ভাণ্ডার। যদিও এতে আধুনিক ইতিহাসের মতো তথ্যনিষ্ঠা সবসময় পাওয়া যায় না এবং ধর্মীয় কুয়াশায় অনেক সত্য ঢাকা পড়ে আছে, তবুও ঐতিহাসিকরা এই সাহিত্যকে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের (লিপি ও মুদ্রা) কষ্টিপাথরে যাচাই করে ভারতের ইতিহাসের কঙ্কালটিকে রক্তমাংস দিয়ে জীবন্ত করে তুলেছেন। তাই প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পুনর্গঠনে দেশীয় সাহিত্যের অবদান অনস্বীকার্য এবং অপরিসীম।

Comments
Post a Comment