সমাজসংস্কারক বিদ্যাসাগরের অবদান
ঊনবিংশ শতকের আর–একজন অসাধারণ পণ্ডিত ও সংস্কারক ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০–৯১ খ্রি.)। মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমাজসংস্কারক বিদ্যাসাগরের প্রতি সম্মান জানিয়ে লিখেছেন—“ বিধাতা বিদ্যাসাগরের প্রতি বঙ্গভূমিকে মানুষ করিবার ভার দিয়াছিলেন”। এবং প্রখ্যাত কবি মাইকেল মধুসূদন লিখেছেন, বিদ্যাসাগরের মধ্যে ছিল সন্ন্যাসীর প্রজ্ঞা, ইংরেজের উদ্যম এবং বাঙ্গালী–মায়ের কোমল হৃদয়।
বিধবাবিবাহ আইন—
(i) প্রচার—নারীমুক্তি আন্দোলনের কাজে বিদ্যাসাগর ছিলেন রামমোহনের যোগ্য উত্তরসাধক। হিন্দুবিধবাদের দুঃখদুর্দশা তাঁর হৃদয়কে বিচলিত করে। বিধবাদের মুক্তির জন্য তিনি আমরণ সংগ্রাম চালিয়ে যান। বিভিন্ন শাস্ত্র বিশ্লেষণ করে তিনি প্রমাণ করেন যে, হিন্দুধর্মে বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত। ‘পরাশর সংহিতা’র একটি শ্লোক উদ্ধৃত করে তিনি বলেন যে, “স্বামী নিরুদ্দেশ হলে, মারা গেলে, ক্লীব প্রমাণিত হলে, সংসারধর্ম ত্যাগ করলে কিংবা পতিত হলে তাঁর স্ত্রী পুনর্বিবাহ করার অধিকারী”।
(ii) আইন পাস—তাঁর এই বক্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করে রক্ষণশীল সমাজপতিরা নানাভাবে বিদ্যাসাগরকে লাঞ্ছিত করেন। কিন্তু জীবন বিপন্ন করেও তিনি এই আন্দোলন চালিয়ে যান। শেষ পর্যন্ত ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই XV রেগুলেশন দ্বারা বিধবাবিবাহ আইনসিদ্ধ বলে ঘোষিত হয়। তাঁর উদ্যোগে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে পরবর্তী দশ বছরের মধ্যে ৬০ টি বিধবাবিবাহ অনুষ্ঠিত হয়।
বাল্যবিবাহের বিরোধিতা—
বিদ্যাসাগর বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে শাস্ত্র ব্যাখ্যা করে প্রমাণ করেন যে, হিন্দুধর্ম বা হিন্দুশাস্ত্রে বাল্যবিবাহের কোনো বিধান নেই। 'সর্বশুভকরী’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় (১৮৫০ খ্রি.) তিনি ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ নামক একটি প্রবন্ধ লেখেন। এই লেখায় তিনি হিন্দু বাল্যবিধবাদের অসহায়তা, দুঃসহ যন্ত্রণা, দগ্ধ জীবনের মর্মব্যথা তুলে ধরেন। এ ছাড়া তিনি বাল্যবিবাহের বিষয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করেন এবং সভাসমিতিতে নিজের বক্তব্য পেশ করেন। তাঁরই অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে সরকার একটি আইন পাস করে মেয়েদের বিবাহের বয়স কমপক্ষে ১০ বছর করে।
(i) বহুবিবাহের বিরোধিতা—সে সময়ে হিন্দু সমাজের বুকে বহুবিবাহ প্রথা জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছিল। বিদ্যাসাগর আগাগোড়া বহুবিবাহের বিরোধিতা করে গেছেন। বিদ্যাসাগর বহুবিবাহ প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বর্ধমানের মহারাজা (মহতাব চাঁদ)-র সহায়তায় ৫০ হাজার মানুষের স্বাক্ষর–সংবলিত এক প্রতিবাদপত্র ব্রিটিশ সরকারের কাছে পাঠান (১৮৫৫ খ্রি.)। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ ব্যাপারে সরকারি তরফে সেসময়ে কোনো সাড়া মেলেনি। কিন্তু বিদ্যাসাগর থেমে থাকেননি। তিনি বহুবিবাহের বিরোধিতা করে আরও দুটি পুস্তক রচনা করেন (১৮৭১ খ্রি.)।
(ii) কুলীন প্রথার বিরোধিতা—সে সময় কুলীন ব্রাহ্মণরা অজস্র বিবাহ করতেন, এমনকি বৃদ্ধ বয়সে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও বহু কুলীন ব্রাহ্মণ কন্যাদায়গ্রস্থ পিতাদের কন্যাদায় থেকে মুক্তি দেওয়ার অছিলায় তাঁদের নাতনির বয়সি মেয়েদের বিবাহ করতে । এই ভণ্ডামি বন্ধ করার জন্য বিদ্যাসাগর কুলীন প্রথার বিরুদ্ধে সরব হন।
অন্যান্য সমাজসংস্কার—
বিদ্যাসাগরের অন্যান্য সমাজসংস্কারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—
(i) তিনি মদ্যপানের বিরুদ্ধেও সরব হন।
(ii) এ ছাড়া ‘সহবাস সম্মতি’ আইনের জন্যও তাঁর অবদান ছিল।
(iii) গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন প্রথা ও কুষ্ঠরোগী হত্যার বিরুদ্ধেও তিনি সরব হন।
(iv) জাতিভেদ, অস্পৃশ্যতা প্রথার তিনি তীব্র নিন্দা করেন এবং এর বিরুদ্ধে তিনি সকলকে সরব হওয়ার আবেদন জানান।
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, রামকৃষ্ণদেবের পর আমি বিদ্যাসাগরকে অনুসরণ করি। বিদ্যাসাগরের চরিত্র ছিল কুসুমের মতো কোমল, আবার বজ্রের মতোই কঠোর। ন্যায় ও সত্যের প্রতি তিনি যতটা অনুগত ছিলেন, ঠিক ততটাই প্রতিবাদী ছিলেন অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে। তাই গবেষক বিনয় ঘোষ লিখেছেন, “রামমোহনের মত আদর্শবাদী (Idealist) বা কৃষ্ণমোহনের মত চরমপন্থী (extremist) কোনটাই বিদ্যাসাগর ছিলেন না। সমকালীন সমাজে তিনি ছিলেন সত্যকার বাস্তববাদী (realist)। আদর্শবাদের সাথে বাস্তববাদের যে সমন্বয় তাঁর চরিত্রে ঘটেছিল, তেমনি আর কারো চরিত্রে ঘটেনি।”
Comments
Post a Comment